- বইয়ের নামঃ দ্য ড্রিম
- লেখকের নামঃ আগাথা ক্রিস্টি
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, রোমাঞ্চকর,গোয়েন্দা কাহিনী
দ্য ড্রিম
১. বনেদী ঐতিহ্যের বাহক
এরকুল পোয়ারো সপ্রশংস দৃষ্টিতে একঝলক তাকিয়ে দেখে নিল বাড়িটা এবং তার পার্শ্বস্থ পরিবেশ। চারিধারে বেশ সাজানো গোছানো নানা ধরনের বিপণী। একটা বিরাট ফ্যাক্টরি বিল্ডিং ডান দিকে। ছোট ছোট ব্লকে ভাগ করা সুলভ মূল্যের ফ্ল্যাটবাড়ি বিপরীত দিকে। তার দু-চোখের কৌতূহলী দৃষ্টি সেই বিরাট নর্থওয়ে হাউসের দিকেই আকৃষ্ট হলো, তারপর ঘুরে ফিরে যেন প্রাচীনকালের কোনো বনেদী ঐতিহ্যের বাহক সেই বাড়িটি। যখন সারা পৃথিবীর বিস্তীর্ণ মাঠ খেত খামার শ্যামল সবুজের সমারোহে ভরা থাকত, এ যেন সেই সময়। সময় তখন ধীর মন্থর গতিতে গড়িয়ে চলত, তখন যেন আর সময় ফুরোতেই চাইত না। অফুরন্ত অপর্যাপ্ত অবকাশ ছিলো। তখন মানুষের হাতে করার মতো তেমন কিছু কাজও ছিল না। এখন সেই ঐশ্বর্য সমৃদ্ধ দিনগুলো আর নেই। যেন মুছে গেছে ধরিত্রীর বুক থেকে সমস্ত চিত্রই। এখন সময় ছুটে চলেছে নিত্য নতুন আবিষ্কার আর যন্ত্র সভ্যতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে, কারণ এখন বিজ্ঞানের যুগ। ক্রমশই যেন ঊর্ধ গতির দিকে যাচ্ছে স্পীডো মিটারের কাঁটা। নিজেকে নিয়েই এখন প্রত্যেকে ব্যস্ত, স্ব স্ব চিন্তায় এখন প্রত্যকেই মগ্ন তাদের কোন অবসর নেই অপরকে নিয়ে চিন্তা ভাবনা করার। আজকের স্থানীয় বাসিন্দারা বলতে পারবে কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। আসলে এই বাড়িটার মালিক কে, এখন সে যে বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ধনবানদের মধ্যে একজন এই বাড়িটার মালিক একথা অনস্বীকার্য। এখন পৃথিবীতে টাকাটাই সব। অনায়াসে নাম, যশ, প্রতিপত্তির শিখরে নিয়ে যায় মানুষকে অর্থের আনুকূল্য, অনেকে আবার নিজের পরিচয় গোপন রাখতেও পারে অর্থের সুনিপুণ প্রয়োগের সাহায্যে। বেনেডিক্ট কার্লে, একজন বাতিকগ্রস্ত ক্রোড়পতি তার অবচেতন মনের অভিলাষও এই রকম। তিনি জনসমক্ষে নিজেকে হাজির করেন খুব কমই। প্রতিবেশীদের তার সম্বন্ধে সামান্য জ্ঞানই নেই, যে কি ধরনের মানুষ তিনি, মেলামেশা তো দূরের কথা, তার প্রকৃত পরিচয় অজানা থেকে গেছে, আজও তিনি দূরের মানুষ।
ক্কচিৎ কখনো তার শীর্ণ দেহ এবং খড়গের মতো নাসিকা নিয়ে জনসমক্ষে তাঁর কোম্পানির বোর্ড মিটিং-এ হাজির হন এই অতি বিরল মানুষটি। কোম্পানির অন্য সব পরিচালকগণ ভয়ে চুপ করে যান, তার হম্বিতম্বি, চালচলন দেখে এবং তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর শুনলে। অপ্রয়োজনীয় একটা কথা বলার সাহসও কারও হয় না। অফিসে তার এরকম প্রতিচ্ছবি। সাধারণ মানুষজনের কাছে তিনি যেন এক গল্প কাহিনির নাটক, বাকী সময়ের জন্য, তাদের সঙ্গে নায়কের মতোই আচরণ করেন। তার সীমাহীন হীনমন্যতা একদিকে অন্যদিকে তার বিপুল বদান্যতা পরোপকারের গল্পও লোকের মুখে মুখে প্রচারিত হয়। এছাড়া তাকে নিয়ে একটা মজার কথা প্রচলিত আছে। তার পোষাক পরিচ্ছদের ব্যাপার কিংবা ব্যক্তিগত আচরণ মানুষের কাছে বিশেষ মুখরোচক নয়। নানান রংয়ের বিভিন্ন কাপড়ের টুকরো দিয়ে তৈরি যে পোশাকটা তিনি (ড্রেসিং গাউন) সাধারণত ব্যবহার করেন, সেটার বয়স নাকি কম হলেও আটশ বছর, কিংবদন্তী আছে। তার অতি প্রিয় প্রাত্যহিক খাদ্য বাঁধাকপির স্যুপ আর সুটকি মাছের ডিম দিয়ে তৈরি অম্লমধুর কাসুন্দি। এর ব্যতিক্রম তার জীবনে কোনোদিন ঘটেনি।
তার বহুরূপী চরিত্রের যথাযথ মর্যাদা দেওয়া হবে, যদি আর একটা অদ্ভুত কথা তার বিষয়ে বলা যায়, এটা বিচিত্র বললেই ভালো হয় এবং সবাই এটা জানে। সেটা হলো মশলাদার কুলের প্রতি তার সহজাত ঘৃণা এবং অনীহা।
অন্য সকলের থেকে এরকুল পোয়ারো কোনো ব্যতিক্রম নয়। তিনিও ভালো করে জানতেন, তাদের মতে, এই ভদ্রলোকের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কথা। শুধুমাত্র বিশেষভাবে জানা নয়, ওই মুহূর্ত মনে হয়, সে হয়ত আরও বেশি কিছু জানে অন্যদের থেকেও। তার এই জানাটা অবশ্য অনায়াস লভ্য এটা বলা যায়। মঁসিয়ে কার্লের চিঠিটাই, যেটা তার উদ্দেশ্যে পাঠানো হয়েছিল। সেটাই তাকে বেশি কিছু জানার সুযোগ করে দিয়েছে।
এরকুল পোয়ারো, যাকে সবাই ভালো করে চেনে এই মুহূর্তে তাকে দেখলে মনে হবে, সে যেন ঠিক এখন এক অদ্ভুত ভাবাবেগে আবিষ্ট হয়ে আছে। হয়তো বা কিছুক্ষণ বিষণ্ণ চিত্তে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে রইলো পোয়ারো। মনে মনে সে এই প্রাচীন ঐতিহ্যের ঢাকা পড়ে যাওয়া ইতিহাসের পাতা ওল্টাচ্ছিল। যেন সবকিছুই তার কাছে অস্বচ্ছ, অস্পষ্ট লাগছিল। তার দু চোখের তারা ঢেকে ফেলেছিল বেদনার ধূসর কুয়াশা। মনটা খুব ভারাক্রান্ত হয়েছিল। ধীরে ধীরে গেট পার হয়ে ভেতরের দিকে অগ্রসর হতে লাগল পোয়ারো, সেই ব্যথাক্রান্ত অস্পষ্টতা কাটিয়ে উঠে। সে নিজেই বুঝতে পারেনি। কখন সে যে বাড়ির প্রবেশ পথের দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। বদ্ধ দরজা সংলগ্ন। কলিং বেলের সাদা বোতামটা টিপবার জন্য যন্ত্রচালিত ভাবে হাতটা বাড়িয়ে দিল। আড়চোখে একবার সে দেখে নিতে ভুলল না। সেই ফকে সাবেকী আমলের বড় হাতঘড়িটাও।
নটা বেজে তিরিশ এখন। নিজেকে প্রফুল্ল করে তোলার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কিছু পূর্বের বিষাদ এবং বিষণ্ণভাব কাটিয়ে উঠে। এক্ষেত্রেও সে নিখুঁত ভাবে সময়ানুবর্তিতার প্রমাণ রাখতে পারল তার সহজাত অভ্যাস অনুযায়ী।