- বইয়ের নামঃ মাউসট্রাপ
- লেখকের নামঃ আগাথা ক্রিস্টি
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, উপন্যাস
মাউসট্রাপ
১. হিমেল হাওয়া
হিমেল হাওয়া দেহের হাড় কাঁপাচ্ছে। চারদিকে তখন নেমে এসেছে সন্ধ্যার আঁধার, আকাশের বুকে তখন ভেসে বেড়াচ্ছে পেঁজা পেঁজা বরফ। তার ফলেই চারদিকে অন্ধকার ঘন হয়ে উঠেছে।
এবার দেখা গেল কালো ওভারকোট পরা লোকটিকে। মাফলারটা গলার ওপর দিয়ে থুতনিরও এক অংশ ঢাকা দেওয়া। চোখের কোণ পর্যন্ত টানা কালো টুপি। কার্লভার স্ট্রীট ধরেই পায়ে পায়ে এগিয়ে লোকটি চুয়াত্তর নম্বর বাড়ির সামনে এসে থামল। বন্ধ দরজা সংলগ্ন কলিংবেলের লাল বোতামটি হাত বাড়িয়ে টিপে দিল। দূরে কোথায় একটা অস্বস্তিকর ক্রিরিং…ক্রিরিং শব্দ বাতাসে শোনা গেল। কান পেতে শোনা গেল সেই আওয়াজ।
শ্ৰীমতী ক্যাসির দুহাতই তখন কাজে জোড়া, অথচ বেলের দাবি না মানলেই নয়। ক্যাসি আপন মনে গজগজ করে বলতে থাকে, জাহান্নামে যাক ঘন্টি। সারা জীবনটা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারবে। দরজা খুলে বাইরে উঁকি মারল।
দরজা খুলতেই শোনা গেল খসখসে ও মৃদু কণ্ঠস্বর। নিকষ অন্ধকারের মধ্যে লোকটা যেন একটা পটে আঁকা ছবি। মিসেস লিয়ন…?
ক্যাসি কাটছাঁট উত্তর দিল, তিন তলায় পাবেন। তার মনের ঝাল এখনো মেটেনি। সে আবার বলল–এই সোজা সিঁড়ি। আপনার আসবার কথা কি তার আগে থেকে জানা আছে?
কোনো কথা না বলে আগন্তুক শুধু ঘাড় ঘোরালো একবার ডাইনে, তারপর বাঁয়ে।
ক্যাসি আবার বলল তাহলে এই সিঁড়ি বেয়ে ওপরে চলে যান। দরজায় নক করলেই তার সাড়া পাবেন। মলিন কার্পেট পাতা সিঁড়ি বেয়ে অপরিচিত আগন্তুক যখন ওপরে উঠে গেল তখন পেছনে থেকে তার দিকে তাকিয়ে ছিল ক্যাসি। পরে অবশ্য ক্যাসি স্বীকার করেছিল– প্রথম দর্শনে আগন্তুককে দেখে তার একটু কেমন কেমন ঠেকছিল ঠিকই, তবে ও ভেবেছিল হয়তো ঠান্ডা লাগার জন্যেই গলা বসে গেছে আগন্তুকের। সেইজন্যেই কণ্ঠস্বর এত মৃদু আর খসখসে। তাছাড়া আবহাওয়া এমন ছিল যাতে এই ধরনের ঠান্ডা লাগা কিছুমাত্র বিচিত্র নয়। সিঁড়ির বাঁক নেবার সঙ্গে সঙ্গেই কিন্তু নরম সুরে শিস দিতে শুরু করে ছিল আগন্তুক। অনেক দিনের পুরনো ছেলে ভোলানো ছড়ার সুরই ধ্বনিত হলো তার শিসের মাধ্যমে। তিনটে ইঁদুর অন্ধ, ডাহা তিনটে ইঁদুর অন্ধ।
মলি ডেভিস গেটের সামনে দাঁড়িয়ে নতুন লাগানো ঝকমকে সাইন বোর্ডটার দিকে চোখ তুলে তাকালো।
.
মঙ্কসওয়েল ম্যানর অতিথিশালা
মলি প্রসন্ন খুশিখুশি ভঙ্গিতে মাথা দোলালো। হ্যাঁ, এতক্ষণে কিছুটা পেশাদারী ভাব ফুটে উঠলো; সকলেই স্বীকার করবে সে কথা। তবে অতিথি শব্দের মাঝের অক্ষরটা একটু যেন বড় হয়ে গেছে আকারে। ম্যানরের শেষ অংশটুকুও কেমন যেন ঘেঁষাঘেঁষি। তাহলে মোটের উপর খুব ভালোই দেখাচ্ছে সাইন বোর্ডটা। জিল সত্যিই বেশ ভাল কাজ করেছে। সব ব্যাপারেই জিল বেশ চালাক চতুর। আর তাছাড়া কত রকমের কাজই যে ও করতে পারে। প্রতিদিনই মলি যেন নতুন করে আবিষ্কার করছে তার এই স্বামীটিকে। সত্যিই তার পতিদেবতাটি অসংখ্য গুনের আধার। আর নিজ সম্বন্ধে সে এত কম কথা বলে জিল যে তার প্রতিটি গুণ নিদর্শনগুলিকে খুঁজে খুঁজে বের করতে হয়। নৌ-বাহিনীর লোকেরা খুবই কাজের অন্ততঃ স্বামী হিসাবে– এমন একটা প্রবাদ সে শুনে আসছে বহুদিন ধরেই, এখন সে এই কথাটা হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করলো।
অবশ্য তারা যে নতুন ঝুঁকি নিতে চলেছে তাতে জিলের মত এমন একজন সর্বগুণসম্পন্ন লোকের একান্ত প্রয়োজন। কারণ হোটেল চালাবার ব্যাপারে অভিজ্ঞতা জিল এবং তার মধ্যে নেই। এ বিষয়ে তারা একেবারেই অজ্ঞ। তবে এর মধ্যে একধরনের মজাও আছে। এবং বর্তমান গৃহ-সমস্যা সমাধানেরও একটা ভূমিকা এর মধ্যে আছে।
মলির মাথায় এই প্রথম একটা অভিনব পরিকল্পনার উদ্ভব এল। বেমক্কা একদিন যখন তার অশীতিপর বৃদ্ধা পিসি ক্যাথারিন মারা গেলেন এবং পিসির অ্যাটর্নি তাকে খবর পাঠালেন যে বৃদ্ধা তার একমাত্র আদুরে ভাইঝিকে তার প্রাসাদের মত বিশাল মঙ্কসওয়েল ম্যানরটা দিয়ে গেছেন তখন স্বাভাবিকভাবেই এই দম্পতি ভেবেছিল সেটাকে বিক্রি করে দেবে। ঠাট্টার সুরে তখন জিল বলেছিল, ওঃ সে এক বিরাট প্রাসাদ বললেই চলে। সাবেকী আমলের আসবাবপত্র সেখানে ঠাসা, তার ওপর বাড়ির চারদিকে কি বিরাট বাগান। তবে সে বাগানের হাল যা হয়েছে তা চোখে দেখা যায় না। আগাছায় চারদিকে ভর্তি কারণ মালীদের যা আকাল। গতযুদ্ধের পর থেকে অবশিষ্ট আছে শুধু একজন মাত্র বুড়ো মালী। তার একার পক্ষে বাগানের ওপর নজর দেওয়া দুষ্কর।
সেইজন্য দুজনের সংসারে ব্যবহারের উপযোগী সামান্য কিছু হালকা ধাঁচের আসবাবপত্র সরিয়ে রেখে পুরো বাড়িটাই তারা বিক্রি করে দিতে মনস্থ করল। সেই টাকা থেকে অনায়াসে একটা ছোটখাটো ফ্ল্যাটও কিনে নেওয়া যাবে। কিন্তু অসুবিধা দেখা দিল দুটো।
প্রথমতঃ বাজারে তাদের মনোমত কোনো ছোট ফ্ল্যাটবাড়ী খুঁজে পাওয়া গেল না। আর দ্বিতীয়তঃ বুড়ি পিসির ভিক্টোরিয়ান যুগের আসবাবপত্রগুলো সমস্তই এত বেশি ভারী আর জবরজং তাদের নাড়াচাড়া দুঃসাধ্য ব্যাপার। তার ওপর সন্দেহ আছে সেগুলো লোকেরা কিনবে বিনা।
মলি বললো, তাহলে। সে বলল –আমার মনে হয় আসবাবপত্র যেখানে যা আছে সেই সমেত পুরো বাড়িটাই তো আমরা বিক্রি করে দিতে পারি, এতে খদ্দেরের অভাব হবে না।