- বইয়ের নামঃ দি হলো
- লেখকের নামঃ আগাথা ক্রিস্টি
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, উপন্যাস
দি হলো
০১. শুক্রবার সকাল
০১.
শুক্রবার সকাল ছ’টা তেরো মিনিটে বড়সড় মাপের চক্ষুজোড়া খুলতেই বরাবরের মতো লুসি এ্যাঙ্গক্যাটেল সম্পূর্ণরূপে নিদ্রা কাটিয়ে জেগে উঠলেন এবং চোখ খুলতে যতক্ষণ দেরি, চোখ খোলার সঙ্গে সঙ্গে তার সদা ব্যস্ততৎপর মন সমস্যা সমাধানে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আলোচনার প্রয়োজনেই খুড়তুতো বোন মিডগে হার্ড ক্যাসলকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন এবং সে-ও গতকাল হলোতে এসে হাজির হয়ে গেছে। গৃহকত্রী এ্যাঙ্গক্যাটেল চটপট শয্যা ত্যাগ করে, নিজের অনিন্দ্যসুন্দর কাঁধের ওপর শিথিল হয়ে পড়া পোষাকটা সরিয়ে নিয়ে মিডগের শোবার ঘরের দিকে এগিয়ে চললেন। অহেতুক চিন্তার জাল ভদ্রমহিলার উর্বর মস্তিষ্কে সর্বক্ষণ বিচরণ করে, তাই তিনি চলতে চলতে আপন খেয়ালের বশে কথোপকথনের অবতারণা করে ফেলেন এবং তাই মিডগের জবাবও নিজের উর্বর মস্তিষ্ক থেকেই জোগাতে থাকেন।
লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল মিডগের শোবার ঘরের দরজা খুলে ঘরে পা রাখলেন, কথোপকথনের জের তখনও পুরোদমে চলছে। তিনি বললেন, প্রিয় বোনটি আমার, তুমি নিশ্চয়ই একথা স্বীকার করবে যে, সপ্তাহান্তে অনেক সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে।
সদ্য সুনিদ্রা থেকে হঠাৎ জেগে ওঠা মিডগে অস্পষ্ট স্বরেই বলে ওঠে, আঁ? হ্যাঁ!
লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল চটপট করে খুব দ্রুত জানলাগুলো খুলে দিতেই, ঝঝন শব্দের রেশ তুলে জানলা দিয়ে শরৎপ্রাতের পাংশু আলোর রেখা ঘরে এসে পড়ে। তিনি আপনমনেই বলে ওঠেন, পাখিগুলো সত্যি কি সুন্দর।
মিডগে, কী?
লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল বলতে থাকেন, সে যাই হোক, মোটের ওপর একটা বিষয় পরিষ্কার বোধগম্য হয়ে যাচ্ছে যে, আবহাওয়া কোনো সমস্যা সৃষ্টি করছে না এবং খুব সম্ভব ভালোর দিকে যাবে। কিন্তু তাতে করে কী এসে যাবে, পরস্পরবিরোধী কতগুলো ব্যক্তিত্ব তো ঘরের মধ্যেই এসে ভিড় জমাবে। আমিও বলে রাখছি, গতবারের মতো এবারেও যদি রাউণ্ড গেম নিয়ে কোনো ঝাট বাধে, আর কেউ না বলুক, আমি জাদাকে ছেড়ে কথা বলব না। গতবারের অবশ্য গোলমালের পর আমি হেনরিকে বলেছিলাম। আবার এও ভেবে দেখলাম, এ কাজটা আমার পক্ষে মোটে শোভন হবে না–তাকে তো আনতেই হবে। তাছাড়া জার্দাকে বাদ রেখে জনকে আসতে বলা একদিকে যেমন হৃদয়হীনতা হবে, আবার অন্যদিকে দৃষ্টিকটুও বটে! সবচেয়ে বড় কথা, জার্দা অত্যন্ত ভালো হয়েও যে এমন নির্বোধ হতে পারে এ কথা ভাবতেও অবাক লাগে। যাকগে কি আর করা যাবে।
মিডগে এতক্ষণে নড়েচড়ে বসে বলে ওঠে, আচ্ছা তুমি ঠিক কোন্ ব্যাপারে কথা বলছে বল তো, লুসি?
লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল জবাবে বলেন, আমি সপ্তাহান্তিক ছুটির কথা ভাবছি। কাল যাঁরা আসছেন আমি তাদের কথাই বলতে চাইছি। দিনরাত একটা ব্যাপার আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে, যতই ভাবছি ততই মনটা বড় অস্থির লাগছে। মিডগে, ভাবনার হাত থেকে রেহাই পেতে তোমার সঙ্গে আলোচনায় বসতে চাইছি, মনটা অনেক হালকাও লাগবে। তোমার বিচক্ষণতা আর বাস্তব বুদ্ধির প্রশংসা না করে পারছি না।
মিডগে রূঢ় স্বরে বলে ওঠে, লুসি, জানো এখন ক’টা বেজেছে?
–ঠিক জানি না, তোমার তো অজানা নয়। ঘড়ির কাটা ধরে চলার অভ্যাস আমার কস্মিনকালেও ছিল না।
মিডগের সঙ্গে সঙ্গে জবাব, এখন ঠিক ছ’টা বেজে পনেরো।
বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে সপ্রতিভ থেকেই লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল বলে ওঠেন, তা হবে হয়তো বোন।
মিডগে অপলক নয়নে তাকিয়ে থাকে। সত্যি দিনকে দিন কী অসম্ভব পাগলাটে হয়ে উঠেছে আজকাল লুসি।
মিডগে ভাবতে বসে যায়, কেন যে ওকে আমরা সহ্য করে চলেছি? ওর সঙ্গে মনের মিল রেখে মানিয়ে চলছি-বা কেন?
কিন্তু প্রশ্নটা মনে উদয় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উত্তরটাও মনের মণিকোঠায় এসে হাজির হয়ে যায়, লুসি এ্যাঙ্গক্যাটেলের মুখে মুচকি হাসির রেখা এবং মিডগে তার দিকে দৃষ্টি যেতেই লুসির মোহিনী মায়ার জালে এমনভাবে জড়িয়ে পড়ে যে, মুহূর্তের বিহ্বলতায় মনের সব ক্রোধ আর রূঢ়তা নিমেষে উবে গেল। সারা জীবন ধরে সে যে মোহজাল বিস্তার করে সকলকে ভুলিয়ে রেখেছে, আজ ষাট বছর অতিক্রান্ত হবার পরেও তার সেই শক্তির মহিমা বিন্দুমাত্র ক্ষয়ে যায়নি–সেই জন্যই বোধহয় পৃথিবী জুড়ে গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, এডি. কং এবং সরকারী উচ্চপদস্থ কর্মচারীবৃন্দ সকলকেই অসুবিধা, অসন্তুষ্টি আর হতবুদ্ধিতার শিকার হতে হয়েছে। তার শিশুসুলভ স্বভাব আর চপলতাই তাকে সমালোচনার উর্ধ্বে নিয়ে যেত, ডাগর চোখে বিস্ফারিত নেত্রে কমনীয় ও রমণীয় শুভ্র হস্তদুটো মেলে ধরে ভ্রমরগুঞ্জনের মতো মিষ্টি সুরে বলে উঠতেন, ওঃ, আমি সত্যি দুঃখিত…তাঁর প্রতি সকলের সব অসন্তোষ মুহূর্তের মধ্যে লুপ্ত হয়ে যেত।
লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল এই সময় বলে ওঠেন, প্রিয় বোনটি আমার, সত্যি আমি দুঃখিত, আমাকে আগে থাকতে বলে দেওয়া উচিত ছিল।
–আমি এখন তোমাকে বলে দিচ্ছি…অবশ্য ঘুম তো আমার ভেঙে গেছে, আর বলেই বা। লাভ কি?
-বড়ই লজ্জার কথা! কেন? অসুবিধাটা ঠিক কোথায় হচ্ছে?
লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল বিছানার প্রায় প্রান্তে এসে বসে পড়ে, মিডগের মুহূর্তের জন্য মনে হল কোনো পরী বোধ হয় তার শয্যায় এসে বসেছে।