১. কাঠের ছোট ফটক
০১.
কাঠের ছোট ফটকের সামনে নীলেন্দু দাঁড়িয়ে থাকল।
পৌষের রোদ এখনও কাঁচা, সারা রাতের হিম জমে আছে ঘাসের ওপর পুরু হয়ে, মাঠ-ঘাট শিশিরে ভেজা; শীতের খর বাতাসে এই রোদ যেন গায়ে লাগছিল না।
ট্রেন থেকে যখন নেমেছিল নীলেন্দু তখন সবে রোদ উঠছে। স্টেশন থেকে আসতে খানিকটা সময় গিয়েছে তার। মাইল খানেক পথ। সামান্য কমবেশিও হতে পারে। স্টেশনের বাইরে এসে খাপরার ছাউনি দেওয়া দেহাতি চায়ের দোকানে চা খাবার সময় মহীতোষের বাড়ির খবরটা জেনে নিয়েছিল নীলেন্দু। মহীতোষ–এই নামটার এখানে কোনও বিশেষ পরিচয় নেই। মহীতোষের শারীরিক বর্ণনাও যথেষ্ট হত না যদি না নীলেন্দু দেবযানীর কথা তুলত, আরও কিছু কিছু প্রাসঙ্গিক বিবরণ দিত। বাড়ির খবরটা মোটামুটি জেনে নিয়ে নীলেন্দু চলল রেল ফটকের দিকে। গায়ে লাল রঙের মোটা পুলওভার, গলায় মাফলার, কাঁধে কিট ব্যাগ। পায়ে পুরু ক্যানভাস শ্য! তবু শীত করছিল।
রেলফটকের লোকটা ডান হাতি মাঠ ভেঙে সরাসরি চলে যেতে বলল; কাছাকাছি হবে। মাঠ ভেঙেই এসেছে নীলেন্দু। রাস্তা আর মাঠের মধ্যে এমন কোনও তফাত অবশ্য চোখে পড়ার কথা নয়। দুইই প্রায় সমান এদিকটায়। মাঠ দিয়ে আসতে আসতে নীলেন্দু জায়গাটার জল মাটি বাতাসের মোটামুটি ধারণা করতে পারছিল। মাটি শক্ত, রংটাও ঠিক লাল নয়, খয়েরি, নুড়িপাথর আর কাঁকর যেন মাটির সঙ্গে মেশানো। নেড়া রুক্ষ মাঠের কোথাও কোথাও শীতের মরা ঘাস, কোথাও বা ছোট ছোট বুনো ঝোপ।
জায়গাটা ভাল। জল বাতাস যে স্বাস্থ্যকর বোঝাই যায়। নীলেন্দু স্বীকার করল, মহীতোষদা জায়গাটা পছন্দ করেছে ভালই। চোখ এড়িয়ে থাকার পক্ষে খুবই উপযুক্ত। কলকাতা থেকে অন্তত পৌনে দুশো মাইল।
মাঠ পেরিয়ে বাঁ দিকে তাকাতেই সেই বিশাল শিরীষ। তার সামান্য তফাতে মহীতোষদের বাড়ি।
বাড়ির সামনে এসে নীলেন্দু দাঁড়িয়ে ছিল। কাঁটালতার বেড়া চারপাশে। কাঠের ছোট ফটক। বাড়িটা বাংলো ধরনের, প্রায় চৌকোনো, ছোটখাটো, মাথায় খাপরার চাল, চারদিকে ঢালু করে নামানো, উঁচু বারান্দা, খড়খড়ি করা দরজা। আশেপাশে খানিকটা জায়গা পড়ে, সামনের দিকে কিছু গাঁদাফুল ফুটে আছে, আরও কিছু মুরসুমি গাছ।
নীলেন্দু কাঠের ছোট ফটক খুলে ভেতরে ঢুকল।
কুয়াতলায় কেউ জল তুলছিল। মৃদু শব্দ আসছে। বাড়ির আর কোথাও কোনও শব্দ নেই। মনে হয় বাড়ির লোকজন এখনও ঘুম থেকে ওঠেনি। কিংবা বাইরের দিকে কেউ নেই। অথচ ঘরের দরজা খোলা।
নীলেন্দু বারান্দার সামনে সিঁড়ির কাছাকাছি এসে দাঁড়াল। ডান দিকে কুয়াতলা। বাঁধানো কুয়া। কুয়াতলার গায়ে কয়েকটা পেঁপেগাছ। দেহাতি, মাঝবয়েসি একটি মেয়ে কুয়াতলার একপাশে বসে বাসনপত্র মাজছিল। জোয়ান মতন একজন জল তুলে বালতি ভরছে।
নীলেন্দু ভাবছিল লোকটাকে ডাকবে কি ডাকবে না। তার আগেই ঘরের দিকে সাড়া পাওয়া গেল। নীলেন্দু মুখ ফিরিয়ে বারান্দার দিকে তাকাল।
ততক্ষণে মধ্যের ঘর থেকে কে যেন বারান্দায় বেরিয়ে এসেছিল। নীলেন্দু ডাকার মতন শব্দ করল। পরনে পাজামা, গায়ে কী আছে বোঝা যাচ্ছে না, গলা থেকে হাঁটু পর্যন্ত মোটা চাদর জড়ানো, চাদর না কম্বল বোঝা মুশকিল।
খানিকটা বিস্ময়, খানিকটা বা কৌতূহল নিয়ে ছেলেটি বারান্দার ধারে এসে দাঁড়াল। নীলেন্দু বলল, মহীতোষদা আছেন? বলে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে থাকল। নীলেন্দুর চেয়ে বয়েস কমই হবে। চোখে মুখে এখনও ঘুম জড়ানো। মাথার চুল উসকো-খুসকো।
আছেন। …আপনি? ছেলেটিও নীলেন্দুকে দেখছিল।
আমি কলকাতা থেকে আসছি।
ছেলেটি কিছু বলতে যাচ্ছিল তার আগেই দেবাযানী বাইরে এসেছিল ছেলেটিকে কোনও কথা বলতে। বাইরে এসেই নীলেন্দুকে দেখতে পেল। দেখে যেন বিশ্বাস করতে পারল না। থমকে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল।
নীলেন্দু সিঁড়িতে পা রেখে এমন মুখ করে হাসল যেন দেবযানীকে চমকে দিয়ে মজা দেখছে।
দেবযানী যতটা চমকে উঠেছিল ততটা যেন শঙ্কিত। চমক সামলে মুখের ভাব সামান্য স্বাভাবিক করল। চোখের কোণে তখনও কেমন যেন এক দুশ্চিন্তা।
এগিয়ে এসে দেবযানী বলল, তুমি।
নীলেন্দু বলল, খুব অবাক হয়ে গিয়েছ।
দেবযানী বলল, তা হয়েছি। বলে ছেলেটির দিকে তাকাল। তোর জিনিসপত্তর পরে গুছিয়ে নিস। দশটায় গাড়ি। এখনও অনেক সময় আছে।
ছেলেটি চলে গেল।
নীলেন্দু বলল, কে?
ভাই।
কার? তোমার না মহীদার?
আমার।
কই, আগে কখনও দেখিনি তো! নীলেন্দু হাসল, তোমার এরকম ভাই এখানে আর কজন আছে। বলতে বলতে কাঁধ থেকে কিট ব্যাগের স্ট্র্যাপটা খুলে ফেলল নীলেন্দু।
দেবযানী কথার কোনও জবাব দিল না।
মাটিতে ব্যাগ রেখে নীলেন্দু গলার মাফলার আলগা করে নিল। হেসে বলল, রাগ করলে?
দেবযানী চোখে চোখে তাকাল না নীলেন্দুর, বলল, যা ভাবো।
ওর নাম কী?
আশিস।
এখানেই থাকে?
না; মাঝে মাঝে আসে। এলে দু একদিন থেকে যায়।
নীলেন্দু বারান্দার কোথাও কোনও বসার ব্যবস্থা দেখতে পাচ্ছিল না। একেবারে ফাঁকা। পকেটে হাত দিয়ে সিগারেটের প্যাকেট দেশলাই বার করতে করতে বলল, তোমার কথা শুনে মনে হল, তোমার আশিস আজ চলে যাচ্ছে।
দেবযানী আড়চোখে নীলেন্দুকে দেখল। বলল,তোমারও কথা শুনে মনে হচ্ছে, ছেলেটাকে দেখে তোমার স্বস্তি হচ্ছে না। গোয়েন্দাগিরি শুরু করেছ।