উৎসবের ছায়ায়
সানাই বসেছে, আবার লাউডস্পিকারও। গোটা পাড়াটাই গমগম করছে। কাল দুপুরে যখন বর-বউ এল তখনই সানাই, বিকালে রেকর্ড। আজ সকালে সানাই, দুপুরে রেকর্ড। সারি সারি চেয়ার রাস্তার দু-ধারে। পথ-চলতি মানুষরা সসংকোচে চেয়ার বাঁচিয়ে টুক করে জায়গাটা পার হয়ে যাচ্ছে। এঁটো পাতার বালতি নিয়ে দুটি ঝি বাড়ি থেকে বেরোতেই চেয়ারের মানুষরা নড়েচড়ে বসল। এক ব্যাচ শেষ হল। খুরি গেলাস ফেলার শব্দ পাশের নন্দী বাড়িতে পৌঁছোতেই কতক–গুলো মানুষ বেরিয়ে এসে চেয়ারে বসল।
ভূতের মতো মানুষগুলো উবু হয়ে এঁটো পাতা গেলাসের মধ্য থেকে খাবার বাছছে। উবু হয়ে ঘাড় নামিয়ে মঞ্জু তাই দেখছিল। ওদের জানলার নাকের তলাতেই আঁস্তাকুড়টা। দেখতে দেখতে মঞ্জু দাঁড়িয়ে উঠল। ঘাড় ফিরিয়ে খুব আস্তে ডাকল—মা।
কণিকা ঘরের ঠিক বাইরের রকটাতেই রাঁধছিল, ডাক শুনে সাড়া দিল মাত্র।
মা, আস্ত আস্ত ছ-টা সন্দেশ।
আচ্ছা আর গুনতে হবে না।
মঞ্জু আর বসল না। দাঁড়িয়েই সে গরাদের ফাঁকে ঠোঁট আর নাকটুকু বার করে দিল। আস্তাকুঁড় থেকে বিয়েবাড়ির গন্ধ আসছে। এ পাড়ায় তারা নতুন এসেছে তাই নেমন্তন্ন হয়নি। সামনের বাড়ির মেয়েরা এখনও সাজছে। হান্টিদি আজ সকালেও ফ্রক পরেছিল, শান্টিদি বিকেলের খোঁপাটা বদলেছে। ওদের সঙ্গে সান্যালদের খুব ভাব। বিয়েবাড়ির ঝি আবার দু বালতি এঁটো ফেলে গেল। ভূতগুলো মাথা নুইয়ে খাবার খুঁজছে।
মা, দেখে যাও কত ফেলে দিয়েছে।
ওদিকে থেকে সাড়া এল না। তাতে কিছু এসে যায় না মঞ্জুর। নাক ফুলিয়ে খুব আস্তে আস্তে নিশ্বাস টানল।
বেড়িয়ে ফিরল কিরণ, অঞ্জু আর রঞ্জ। আর জানলার কাছে মঞ্জুর বসে থাকার উপায় নেই। ওদের নিয়ে এখন খেলতে হবে, নয়তো রান্নার কাছে গিয়ে বিরক্ত করবে।
ঘরের আলো জ্বালল কিরণ। স্কুল ফাইনাল পাস করে মামার কাছে এসেছে। মন্মথ চেষ্টা করছে একটা কাজ ওকে জুটিয়ে দিতে। ডিপো ম্যানেজারকে বলা আছে। সময় হলেই অ্যাপ্রেন্টিস করে ঢুকিয়ে দেবে।
ঘরের আলো নিবিয়ে কিরণ বেরিয়ে গেল। মঞ্জু, অঞ্জু, রঞ্জু অন্ধকারে বসে রইল। আলো জ্বালালে মিটার খরচ বেশি হয়। কণিকা লক্ষ জ্বালিয়ে রান্না করে। জানলার কাছে গুটিগুটি ওরা তিন ভাই-বোন দাঁড়াল। শুধু একটা লোক তখনও খাবার খুঁজছে। আর সবাই দূরে রাস্তার আলোয় নিজের নিজের পুটলি গোছাচ্ছে। রান্না হয়ে গেছে কণিকার। হেঁশেল ঘরে ঢুকল। অন্য দিনের মতো বাচ্চারা হুটোপাটি করেনি তাই সে অবাক ছিল রান্নার সময়, আলো জ্বেলেই দেখল তিন জন জানলায় ঠাসাঠাসি করে রয়েছে। ওদের ওপর দিয়ে উঁকি দিল কণিকা।
কী করছ এই নোংরার সামনে বসে?
দেখছি তো।
দেখার কী আছে, আঁস্তাকুড় কখনো দেখনি?
মা দিদি বলছিল অনেক সন্দেশ ফেলে দিয়েছে। ওখানে আছে। দোষটা আসলে তার নয়, অঞ্জু এই কথাটাই বোঝাতে চাইল। মা বুঝেছে কি না এই কথাটা জানতে তিন জোড়া চোখ কণিকার মুখে বিঁধে রইল। কী বুঝল কণিকা, আলোটা নিভিয়ে জানলার ধারে দাঁড়াল, মাথাটা হেলিয়ে কোনোরকমে এক চোখ দিয়ে সান্যাল বাড়ির দরজা পর্যন্ত দেখা যায়। কণিকা দেখতে লাগল।
ঘাঁটতে ঘাঁটতে লোকটা খাবার মুখে পুরছিল। হঠাৎ হেঁচকি তুলতে শুরু করল।
কণিকা সেই একভাবে এক চোখ দিয়ে দেখছে। হঠাৎ সে বলল, হ্যাঁ রে মঞ্জু, ওই মেয়েটা বাসে করে ইশকুল যায়?
মঞ্জু ঘাড় কাত করে কণিকার মতো এক চোখ দিয়ে দেখল।
হ্যাঁ, ও টিনাদি।
আর ওর পাশেরটা?
দেখতে পাচ্ছি না।
কণিকা মঞ্জুকে আর একটু জায়গা ছেড়ে দিল।
ও তো বাসু, হেঁটে ইশকুল যায়।
দ্যাখ দ্যাখ ওই কোলের ছেলেটাকে।
নিমন্ত্রিত কয়েক জন মহিলাদের একজনের কোলে বাচ্চা। মাস ছয়েক বয়স।
ঠিক ওইরকম একটা ফ্রক বড়োমামি তোকে দিয়েছিল, ঠিক ওই রকম রং। কবে মা?
তোর ভাতের সময়।
রঞ্জু কী একটা বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ সানাই বেজে উঠল, ওরা চুপ করে গেল। কিছুক্ষণ পরেই রঞ্জু বলল, ওই লোকটাকে ঠিক বাবার মতো দেখতে।
কোনটা?
ওই যে সিগারেট খাচ্ছে।
দূর, ও তো মোটা আর পাঞ্জাবি পরেছে।
মঞ্জুর কথা শেষ হতেই কণিকা বলল, তোদের শম্বুকাকার বিয়েতে তোর বাবা বরযাত্রী গেছল। পাঁচ-ছটা সিগারেট এনেছিল।
তুমি গেছলে?
ওরা তিন জনে মুখ তুলে তাকাল।
মা তুমি নেমন্তন্ন খেয়েছ?
তিন জোড়া চোখ বিধে আছে। কণিকা জবাব দিল না। ওরা একসময় চোখ সরিয়ে নিল।
মঞ্জুর ভাতে অনেকে আমাদের বাড়ি নেমন্তন্ন খেয়ে গেছে।
আবার তিনটে মাথা ঘুরে গেল। গরাদে নাক চেপে কণিকা হাসল, ওরা তা দেখতে পেল না।
দুটো রসুই বামুন ভাড়া করা হয়েছিল। রাসবিহারীবাবুদের ছাদে লোক খেয়েছিল। এমনি রাস্তার দু-ধারে চেয়ার পেতে লোক বসেছিল কত যে খাবার ফেলা গেছল।
রেখে দিলে না কেন? পরের দিন খেতে।
অনেক বেঁচেছিল। বিষ্ণুদের বাড়ি, হরিঠাকুরঝিদের বাড়ি, তোর বাবার বন্ধুদের বাড়ি খাবার পাঠানো হয়েছিল।
সান্যাল বাড়ি থেকে একসঙ্গে অনেকে বেরোচ্ছে, কণিকা তাড়াতাড়ি গরাদের ফাঁকে চোখ রাখল। বোধ হয় মেয়ের বাড়ির লোক, বর নিজে এগিয়ে দিতে এসেছে।
মা, আর ভাত হবে না আমাদের বাড়ি?
মা, মঞ্জু কি বোকা দ্যাখো, বড়ো হয়ে গেলে আবার ভাত হয় নাকি?
হঠাৎ জানলা থেকে সরে গেল কণিকা। মন্মথ আসছে।
কলঘর বাড়িওয়ালার এক্তিয়ারে। বাড়িওয়ালার বউ খুঁচিবেয়ে, পাইখানা যেতে গিয়ে মন্মথ এক ফোঁটাও জল পেল না। অশ্রাব্য দু-একটা গাল শুরু করেছিল মন্মথ। কণিকা তাড়াতাড়ি খাবার জলের কলসি থেকে ঢেলে দিল। মন্মথ এলেই ভাত বেড়ে দেবে। ছেলে-মেয়েরাও বসবে ওর সঙ্গে। যাওয়ার সময়কার বিরক্তিটুকু সঙ্গে নিয়ে মন্মথ ফিরে এল। চানের জল নেই। গামছা ভিজিয়ে বুকে-পিঠে জোরে জোরে ঘষল।