কলাবতী
কলাবতী – মতি নন্দী
স্পোর্টিংলি আমাকে বিচার করবেন
”কম্পিটিটারস ফর দ্য গো অ্যাজ ইউ লাইক ইভেণ্ট, প্লিজ বি রেডি।”
অ্যামপ্লিফায়ারে কথাটা দুবার গাঁক গাঁক করল। তাই শুনে লেডিজ পার্কের মধ্যে ছড়িয়ে থাকা মেয়েরা তাড়াতাড়ি এগোল শামিয়ানার দিকে।
কাঁকুড়গাছি উচ্চচ মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের বাৎসরিক স্পোর্টসের শেষ ইভেণ্ট টিচারদের ব্যালান্স রেস তখন শুরু হতে যাচ্ছে। এটা আসলে ছিল ১০০ মিটার দৌড়।
কিন্তু অনেকেই আপত্তি জানান, অতটা দৌড়তে গেলে তাদের দমে কুলোবে না। তিন দিন তর্কের পর ঠিক হয়, ৫০ মিটার ব্যালান্স রেস। এরপর চার দিন গভীর আলোচনা হয়, কী দিয়ে ব্যালান্স হবে? মাথায় কলসি, হাঁড়ি, সরা, বই—খাতা না দাঁতে চেপে থাকা চামচে রসগোল্লা নিয়ে?
দেশে খরা চলছে, দুঃস্থ মানুষদের কষ্ট বিবেচনা করে খরচ কমাবার কথা ভেবে অবশেষে মাটির সরা মাথায় রেখে ব্যালান্স দৌড়ই স্থির হয়, অবশ্যই বিঁড়ে ছাড়া।
শামিয়ানার নীচে একটা লম্বা টেবল। তাতে প্রাইজ সাজানো। প্লাস্টিকের রঙ—বেরঙের ঝুড়ি, বালতি, টিফিন বাক্স, স্টেইনলেস স্টিলের রেকাবি, ট্রে ইত্যাদি। ফোম রাবারের তিনটি মেয়েদের হাতব্যাগ আর একটা শিল্ড। সভাপতি একজন প্রবীণ সাংবাদিক। তিনি হাজির হওয়ামাত্রই, ওয়ার্ক এডুকেশনের টিচার অসীমা দত্ত শ’খানেক সার্টিফিকেট তাঁর সামনে রেখে যান সই করার জন্য। সভাপতি ঘাড় গুঁজে সই করতে করতে মাঝে মাঝে জিরোবার জন্য পাশের চেয়ারে বসা হেডমিস্ট্রেস মলয়া মুখার্জির সঙ্গে স্কুলের খেলার ব্যবস্থা নিয়ে দু’চার কথা জিজ্ঞাসা করছিলেন। হেডমিস্ট্রেসকে টিচাররা বড়দি বলেন। বয়স প্রায় চল্লিশ, দেখতে সুন্দরী, শিক্ষা বিষয়ে বিলিতি ডিগ্রি আছে। কেন যে বিয়ে করেননি টিচার বা ছাত্রীরা তাই নিয়ে প্রচুর মাথা ঘামিয়ে কিছুই আবিষ্কার করতে পারেনি।
”স্কুলের মাঠই নেই, খেলার ব্যবস্থা করব কী করে?” একটু থেমে ”তবে খেলাধুলোয় উৎসাহ আমরা দিই, খুবই দিই। আমাদের একটি মেয়ে… অসীমা, কী যেন নাম, ওই যে সাঁতারে…”
”সেভেন বি’র রেবা বাড়ুরি, স্টেট চ্যাম্পিয়ানশিপে দুটো রেকর্ড করেছে।”
”হ্যাঁ হ্যাঁ রেবা, ওকে আমরা খুব উৎসাহ দিই। প্র্যাকটিসে যায় বলে দু’ পিরিয়ড আগে ওকে ছেড়ে দেওয়া হয়। আর একটি মেয়ে, কলাবতী সিংহ, এবার মেয়েদের ক্রিকেটে বেঙ্গল টিমে খেলেছে। ক্লাস ইলেভেনে পড়ে, স্টেডি ব্যাট। ইউ.পি—র এগেনস্টে দু’ ঘণ্টা ক্রিজে থেকে বেঙ্গলকে জিতিয়েছে, দারুণ ড্রামাটিক ম্যাচ হয়েছিল, তাই না অসীমা?”
সভাপতি খুবই ঔৎসুক্য দেখিয়ে অসীমা দত্তর দিকে তাকালেন। সেই সময়ই ফিজিক্যাল সায়ান্স আর ইতিহাসের টিচার দু—জন মুখ ভার করে হাজির হলেন।
”কী কাণ্ড দেখুন তো বড়দি। ননীগোপালবাবু আর বসন্তবাবু বলছেন তাঁরাও ব্যালান্স রেসে নামবেন। ওঁরা বলছেন, পুরুষ টিচারদের নামা বারণ এ কথা তো কোথাও বলা নেই। শুধু মেয়েরাই নামবে আর প্রাইজ নেবে, এটা নাকি অগণতান্ত্রিক, তাই ওঁরা দুজন নামবেনই।”
”আচ্ছা, বড়দি, আমরা কি প্রাইজের দিকে তাকিয়ে রেসে নামছি? ওঁরা এমন একটা হিণ্ট দিলেন যে, সব মেয়ে টিচারই খুব রেগে গেছে, বলছে রেস বয়কট করবে।”
বিব্রত হেডমিস্ট্রেস, ”অ্যাঁ! তাই নাকি? কী কাণ্ড?” এই তিনটি শব্দ ছাড়া বলার মতো আর কথা পেলেন না। তিনি একটু ভয়ও পেয়ে গেলেন ‘অগণতান্ত্রিক’ আর ‘বয়কট’ শব্দ দুটোয়। দেশ হোক, রাজ্য হোক, আর মেয়েদের স্কুলই হোক, যাঁরাই এসব চালনার দায়িত্বে আছেন, তাঁদের কাছেই এইসব শব্দ এখন টাইমবোমার মতো। কখন যে ফাটবে কেউ তা জানে না।
”তাহলে কী করা যায়?”
হেডমিস্ট্রেস পরামর্শের আশায় সভাপতির দিকে তাকিয়ে রইলেন। সভাপতি না শোনার ভান করে সার্টিফিকেটগুলোয় সই করে যাচ্ছেন।
”মাত্র দু জন তো, নামুক না। পুরুষদের ব্যালান্স মেয়েদের থেকে কমই হয়।”
”বা রে, মেয়েদের সঙ্গে রেসে পুরুষরা নামবে, এ কেমন কথা?”
”তা ছাড়া ননীবাবুর বাড়ির কাছে পাতাল রেলের কাজ দু বছর ধরে চলছে, হাঁটাচলায় ওঁর ব্যালান্স অনেক বেড়ে গেছে। উনি ফার্স্ট হবেনই।”
”হয় যদি হোক, তাই বলে ওঁর পার্টিসিপেশন তো বন্ধ করা যায় না, সেটা খুবই অগণতান্ত্রিক হবে তাহলে!”
”কিন্তু উনি যে আনডিউ অ্যাডভাণ্টেজ নিয়ে নামবেন তাও আমরা হতে দেব না। বয়কট করব।”
হেডমিস্ট্রেস মলয়া মুখার্জি বিব্রত হয়ে আবার সভাপতির দিকে তাকালেন। সভাপতি মুচকি হাসছেন অর্থাৎ কথাবার্তা সবই তাঁর কানে গেছে। গলাখাঁকারি দিয়ে তিনি বললেন, ”অংশগ্রহণই আসল কথা, পুরস্কার পাওয়াটা নয়। ঘোষণা করে দিন, ব্যালান্স রেসে কোনো পুরস্কার নেই।”
”অ্যাঁ, প্রাইজ থাকবে না।”
ফিজিক্যাল সায়ান্স আর ইতিহাস হতাশায় ভেঙে পড়লেন। এই রেসের জন্য আলাদা ব্যবস্থা করে একটু বেশি দাম দিয়ে তিনটি লেডিজ হ্যাণ্ডব্যাগ কেনা হয়েছিল। টেবলের একধারে সেগুলো সাজিয়ে রাখা। দুজনে ব্যাগগুলোর দিকে কটমট করে একবার তাকিয়ে সেখান থেকে চলে গেলেন।
”বাঁচালেন। নইলে কী মুশকিলেই যে…”
হেডমিস্ট্রেসের কথা শেষ হবার আগেই গাঁক গাঁক শব্দে ঘোষণা হল: ”যথেষ্ট সংখ্যক প্রতিযোগীর অভাবে টিচারদের ব্যালান্স রেস শুরু করা যাচ্ছে না, মাত্র দুজন—ননীবাবু আর বসন্তবাবু স্টার্টিং লাইনে এসেছেন। অনুরোধ করা হচ্ছে বাকি টিচাররাও তাড়াতাড়ি আসুন।”