- বইয়ের নামঃ যুবক জীবন
- লেখকের নামঃ লুৎফর রহমান
- প্রকাশনাঃ জয় প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃআত্মজীবনী
০১-০৫. যৌবনের ঔদ্ধত্য
০১. কথা আরম্ভ–যৌবনের ঔদ্ধত্য
যৌবনকালে যুবকদের মনে অহঙ্কার এবং ক্রোধ সর্বদাই লেগে থাকে। নিজে যেন সে একটা মস্ত বড় দরের মানুষ। পরের সামান্য প্রতিবাদে ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠা তার স্বভাব।
একবার একটা যুবক টাকা ভাঙ্গাবার জন্য এক সরকারি অফিসে যেয়ে উপস্থিত হন। সরকারি অফিসে কখনও টাকা পয়সা দেওয়া হয় না। তথাপি যুবক যখন টাকা পয়সা পেলেন না তখন তার ক্রোধের সীমা রইলো না, তিনি সমস্ত রাজকর্মচারী সমাজকে গালি দিতে আরম্ভ করলেন। যুবকের যে এটা অন্যায় জিদের দাবি, সে কথা ভাববার সহিষ্ণুতা কী তার ছিল?
ধীরচিত্তে বিবেচনা করবার স্বভাব যুবকদের মোটেই নাই। এক সভায় কতকগুলি যুবক ছিলেন। তারা একত্রে দশ-বার জন ছিলেন। ভাব প্রকৃতি দেখে মনে হচ্ছিল, বোধ হয় তারা কোনো রাজ্য জয় করতে বেরিয়েছে বা কোনো পাহাড় ভেঙ্গে গুড়ো করতে যাচ্ছেন। সেই রাস্তা ধরে অপর দিক থেকে এক পথিক আসছিল-যুবকদের নিকটে আসতেই একজন ধাক্কা মেরে ক্লান্ত পথিককে পার্শ্বের ড্রেনের ভিতর ফেলে দিল। পথিক ক্রুদ্ধ হয়ে বল্ল”তোমরা কি কানা? অমনি যুবকেরা সমস্বরে আগুন হয়ে বল্লে–ব্যাটার তো ভারি তেজের কথা। নিজে এসে গায়ের উপর পড়লেন,–এখন উল্টো দাবি করছেন। পথিক যদি আর একটু প্রতিবাদ করতেন, তা হলে যুবকদের হাতে তাকে অপদস্থ হতে হত নিশ্চয়।
যুবকদের গায়ের জোরে আস্থা খুব বেশি। বিচার-বুদ্ধি, বিবেকের দাবি তাদের কাছে নাই। ঔদ্ধত্য প্রকাশ তাদের স্ব-প্রকৃতি।
যুবকেরাই যুদ্ধের যোগ্য।–লড়াই করা, নিজের জীবনের মায়া না করা ওদের স্বভাব। নিজে ছোট বা দুর্বল, পরাজয়ের বিপদ তার ভাগ্যেও ঘটতে পারে একথা সে মোটেই বিশ্বাস করে না।
যুবকের ঔদ্ধত্যের সম্মুখে যারা ঔদ্ধত্য প্রকাশ করতে চায়, তারা বড় ঠকে। যুবক কোনোমতে দমে না। যৌবনের শক্তি অতি প্রচণ্ড। যৌবন শক্তির কাছে কত সেনাপতিকে পরাজয় স্বীকার করতে হয়েছে।
যুবকদের মনুষ্যত্বের কাছে নিবেদন কর–তার সঙ্গে প্রেমের ব্যবহার কর, তার কাছে নত হও–তার বিচারবুদ্ধির আশ্রয় নাও,–তার দয়া ভিক্ষা কর,–তা হলেই তাকে জয় করতে পারবে। সে তোমার হবে দাস এবং অনুগত বন্ধু।
মধুর ব্যবহার করাই যুবককে জয় করবার প্রধান অস্ত্র। সে সম্মান চায় না–সে চায় ভালোবাসা; সদ্ব্যবহার এবং প্রেম প্রেম ও সদ্ব্যবহার তাকে লমিতো করে।
যুবক জীবনে দুর্বলতা কোথায়? মধুর ব্যবহারের সম্মুখে, সহানুভূতিতেই সে দুর্বল। আর কোনো ক্ষেত্রে সে দুর্বল নয়। তরবারি দেখে, আগুন দেখে, কারাগারে, ফাঁসিতে–কিছুতেই তার দর্পিত প্রাণ কাবু হয় না–যদি বাঁচতে চাও, তবে তার সঙ্গে সন্ধি কর;–তবে কখনও তার সঙ্গে নীরস কঠিন ব্যবহার করো না।
যুবকেরা পাগল, বারুদের মতো সহজেই যুবকপ্রাণে আগুন ধরে। এদেরকে জননীর মতো বাবা’ বলে স্নেহ করাই উচিত। কারণ এদের মধ্যে স্থিরতা, ধীরতা, গাম্ভীর্য, ধর্মভয়, বিনয়,জ্ঞান বলতে কিছু নাই।ওরা সত্যিই পাগল–যুবককে বাষ্পীয় ইঞ্জিন–আবদ্ধ শক্তি বলা যয়। বুদ্ধিমান যিনি তিনি যৌবনশক্তিকে সুপথে চালিত করেন এবং তার সাহায্যে জগতে আশ্চর্য আশ্চর্য কাজ করেন। জাতির যৌবনকে ব্যবহার করতে শেখ–তুমি জাতির পরম কল্যাণ করতে পারবে। যুবকের প্রাণ বড় সুন্দর, বড় মধুর–যে ওকে ব্যবহার করতে শিখেচ্ছ, সেই জগতের রাজা হতে পেরেছে।
যৌবনের পরম দানকে কামুকতায়, শুক্রক্ষয়ে, পাপের পথে নষ্ট করে ফেল না। স্থবির হয়ে জীবনের পরম সৌভাগ্য হতে বঞ্চিত হয়ো না। যৌবনের বলহারা যে হল; সে রাজ্য হারা হল। যৌবন শক্তির সদ্ব্যবহার করো।–মহাকালে, ঐশ্বরিক কার্য্যে তোমার যৌবনকে ব্যবহার করো। তোমার জীবনে বসন্ত জেগেছে, এ বসন্ত কি বৃথা হয়ে যাবে তোমার কাছে? বসন্তকে পূজা করে ঘরে তুলে নাও! —
যৌবন ছাড়া জীবনে দুঃখ হাসিমুখে আর কে অত সইতে পারে? প্রচণ্ড টাইবার নদীর বুকে অসীম সাহসে কে লাফিয়ে পড়তে পেরেছিল–সে যৌবন।
যৌবনশক্তির অপব্যবহার দেখলে আমাদের দুঃখের অন্ত থাকে না। যে যৌবন পৃথিবীতে শান্তি ও কল্যাণের মন্ত্র প্রচার করবে, তাই যদি দানবের মূর্তিতে পৃথিবীতে অশান্তি ও দুঃখ সৃষ্টি করে তবে সে কথায় অভিযোগ মানব ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব নয়।
অনেক দিন আগে, দুই হাজার বছরেরও বেশি দিন আগে সমস্ত পৃথিবী জয় করবার ইচ্ছায় মেসিডেনের রাজা আলেকজাণ্ডার সুদূর ভারতবর্ষ অভিমুখে যাত্রা করেছেন। তাকে এশিয়া মাইনর, আরব, পারস্য ও আফগানিস্তান প্রভৃতি দেশের ভিতর দিয়ে ভারতবর্ষে উপস্থিত হতে হবে। এশিয়া মাইনরে অতীতের পরাক্রমশালী ফিনিসীয় জাতির বাস। তাদের রাজধানী টায়ারের ধারে আলেকজাণ্ডার সসৈন্যের উপস্থিত হয়ে নগরের প্রতিষ্ঠিত দেবতাকে পূজা দিতে ইচ্ছা করে প্রধানদের কাছে সংবাদ পাঠালেন। উপকূল হতে পশ্চিমে অনেক দূরে সমুদ্রের ভিতর রাজধানী টায়ার অবস্থিত। সর্বদেশের, সর্বজাতীয় লোক পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নগর ও ক্রয়-বিক্রয়ের কেন্দ্র স্থান বলে, এখানে বাস করে। অতীতকালে এশিয়া ও ইউরোপের মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত ফিনিসীয় জাতির এই নগরের মতো সমৃদ্ধিশালী নগর আর ছিল না। পৃথিবীর অফুরন্ত সম্পদ এখানে সঞ্চিত হয়েছিল, অন্তহীন মানুষের বাস এখানে ছিল।