পরকীয়া – প্রণব সেন
এখনও বাড়ি ফেরেনি কাবেরী। এগারোটা না বাজলে ওর হয়ত বাড়ির কথা ভাবার সুযোগই আসে না। এত রাত পর্যন্ত বাইরে থাকার জন্য ওকে কোনও কৈফিয়ত দিতে হয় না। সেইজন্যই ও বোধহয় এই সংসারের সঙ্গে এক কৃত্রিম যোগসূত্র বজায় রেখে বেশ খোশমেজাজেই থাকতে পারছে। অন্তত রাতের অন্ধকারে যারা নিজের পরিচয় বদলে শয্যা পরিবর্তনের খেলায় মেতে ওঠে, তাদের সমগোত্রীয় বলে যাতে কারও মনে ভুল ধারণায় সৃষ্টি না হয় তার দিকে সতর্ক দৃষ্টি বজায় রাখার প্রচেষ্টা চালাতে বিন্দুমাত্র অন্তরায় না গড়ে ওঠে। কাবেরী নিশ্চয়ই এই মানসিকতাকে সমসাময়িক কালের নারী স্বাধীনতা হিসাবে চিহ্নিত করেছে।
প্রতিদিন কোথায় যায় কাবেরী? এ প্রশ্ন সুশার। দশটা পাঁচটার উদভ্রান্ত কেন্দ্রীয় সরকারী কেরানীর এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার অধিকার কি আছে? রাতের শয্যায় কাবেরী যে ফিরে আসে, এটুকু পেয়েই সুশান্তকে পরিতৃপ্ত থাকতে হয়। কাবেরীর স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করলে অশান্তি বাড়ে। সেই যন্ত্রণার শিকার হতে চায় সুশান্ত। তাই নীরবতাকেই বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে।
এই কাবেরীকেই আঠারো বছদ্র আগে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল সুশান্ত। তার মূল্য কি ওকে এভাবেই দিতে হবে? কাবেরী সেদিনের গড়ে ওঠা সম্পর্ককে আজ কি একটুও মর্যাদা দিতে চায় না? না কি সেই বোধ ও মন থেকে মুছে ফেলেছে? অথচ সেদিন কাবেরী বিয়ের জন্য কত উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিল। সুশান্তকে বলেছিল, আগামী এক মাসের মধ্যে তুমি যদি বিয়ে করতে রাজী না হও, আমাকে আত্মহত্যা করতে হবে। সেদিনের কথা কি ভুলে গেছে কাবেরী? সুশান্ত সেই প্রসঙ্গ উত্থাপন করলে কাবেরী এতটুকু গুরুত্ব না দিয়ে বলেছিল, তখনকার পরিস্থিতিতে আমি বাধ্য হয়েছিলাম। কিন্তু তাকে মূল্য দিতে সারাজীবন ধরে তোমার কেনা বাদী হয়ে আমাকে থাকতে হবে নাকি? তা যদি ভেবে থাকো তাহলে অত্যন্ত ভুল করেছ।
সত্যিই ভুল করেছে সুশান্ত। আজ ওকে সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হচ্ছে। কিন্তু কাবেরী যে এক অবৈধ সম্পর্ককে চাপা দিতে চেয়ে সুশান্তকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তখন ও সে কথা জানতে পারেনি। সুশান্ত প্রথম যেদিন ওবাড়িতে শ্যামলকে দেখেছিল, সেদিন কিন্তু একবারও মনে হয়নি এই মানুষটা ধীরে ধীরে দু’জনের এতদিনের সম্পর্কের মধ্যে দূরত্বের পাঁচিল গড়ে তুলবে। আর এমন আগুন। জ্বালাবে কাবেরীর মদতে, যার আঁচে একটু একটু করে পুড়বে সুশান্তর মন। শ্যামলের। প্রসঙ্গ নিয়ে কাবেরী আগে কখনই বিশেষ আলোচনার পক্ষপাতী ছিল না। সুশান্ত শুধু এইটুকুই জেনেছিল শ্যামল সম্পর্কে কাবেরীর মামা। শিবপুরের বাড়িতে কয়েকবার এসেছিল। মিলিটারীতে চাকরি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বাইরে চলে যায়। সেই কারণে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। বিয়েতে শ্যামল আসেনি। দূরত্ব যে বিরহের যন্ত্রণা জাগিয়ে তুলেছিল দুজনের মনে আজ বুঝতে পারছে সুশান্ত। তাই আবার যোগাযোগ স্থাপিত হলে অপরিপূর্ণ কামনার নিবৃত্তি ঘটাতে দুজনে অনিয়ন্ত্রিত বোধে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। যেখানে সামাজিক বিধি, বিবেক, কর্তব্যবোধ সবকিছুই অবহেলিত।
কেন ভালোবাসার অভিনয় করে প্রতারণার খেলায় মেতে উঠেছিল কাবেরী? শ্যামলকে বিয়ে করা সম্ভব ছিল না। অবৈধ সম্পর্ককে সামাজিক স্বীকৃতি দিতে চাইলে কাবেরী কারোরই সমর্থন পেত না। শ্যামলের প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করতে বাধ্য হয়েছিল। শ্যামল প্রত্যাশা না মেটায় অভিমানে আহত হয়ে নিজেকেই দূরে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সারাজীবন উপবাসী থেকে জীবনপিপাসা না মেটানোর পথও বেছে নেওয়ার পক্ষপাতী ছিল না কাবেরী। সেই নিঃসঙ্গ মুহূর্তে কাবেরী কাছে পেতে চেয়েছিল একজন পুরুষকে। তখনই ওর জীবনে আসে সুশান্ত। এক অনিশ্চিত জীবন ছেড়ে নিরাপত্তা খুঁজে পাবার আকাঙ্ক্ষায় কাবেরী আঁকড়ে ধরেছিল সুশান্তকে। তাকেই সত্য বলে মেনে নিয়েছিল সুশান্ত, কোথাও ছলনার আভাস খুঁজে পায়নি। বিশ্বাস করেছিল কাবেরীকে। এমন আত্মনিবেদনের মধ্যে বিরাট ফাঁকি লুকিয়েছিল, কি করে বুঝবে সুশান্ত?
সুশান্তর মনে অশান্ত ঝড় বয়ে চলেছে। কাকে শোনাবে প্রতারিত হবার কাহিনী? কিন্তু সহ্যের সীমা অতিক্রম করে গেলে নীরবতার কাছে আশ্রয় কি সুশান্তকে স্বস্তি দিতে পারবে?
তুলিকা এসেছিল কাবেরীকে গৃহপ্রবেশের নেমন্তন্ন করতে। কাবেরী কোথায় গেছে জানতে চাইলে সুশান্ত বলল, তোমার দিদির খবর আমি রাখি না। ওর সঙ্গে দেখা করতে হলে রাত এগারোটার পর তোমাকে আসতে হবে। এত রাত পর্যন্ত ও বাড়ির বাইরে থাকে, অথচ আপনি কিছু বলেন না?
সুশান্ত আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেনি। এতদিনের জমানো ক্ষোভ আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের মতো বুক থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলো। সুশান্ত বলল, তোমরা আমাকে ঠকিয়েছ। আমার বিশ্বাসকে নিয়ে প্রতারণা করেছ। আজ এসেছ আমাকে…
তুলিকা এমন আক্রমণাত্মক ভঙ্গীতে সুশান্তকে দেখে খুবই অবাক হয়ে বলল, কি হয়েছে সুশান্তদা! আমি কি কোনও অপরাধ করেছি?
অপরাধী তুমি একা নও, তোমরা সবাই। তোমার দিদি যে অন্য কারোর সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিল, সে ঘটনা চাপা দিতেই তোমরা আমাকে বেছে নিয়েছিলে। আমি তোমাদের কাছে খেলার পুতুল ছিলাম, তাই না? তোমরা সবকিছু গোপন করে রেখে আমার জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছ। তোমরা পারবে আমার হারানো দিনগুলো ফিরিয়ে দিতে? আমি এখন প্রতি মুহূর্তে যন্ত্রণার আগুনে পুড়ছি। আমি কি করবো জানি না। পরিস্থিতি অসহ্য হয়ে উঠলে আমাকে হয়ত শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করতে হবে।