- বইয়ের নামঃ অলীক মানুষ
- লেখকের নামঃ সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
- প্রকাশনাঃ দে’জ পাবলিশিং (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. কালো জিন এবং শাদা জিন বৃত্তান্ত
অলীক মানুষ – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
প্রথম প্রকাশ : বৈশাখ, ১৩৫৫
দে’জ পাবলিশিং ১৩ বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০৭৩
প্রচ্ছদ : গৌতম রায় প্রকাশক : সুভাষচন্দ্র দে।
লেজার টাইপ সেটিং : পেজমেকার্স ২৩বি রাসবিহারী এভিনিউ, কলকাতা ৭০০০২৬
মুদ্ৰক : স্বপনকুমার দে। দে’জ অফসেট ১৩ বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০০৭৩
উৎসর্গ
আব্দুর রউফ, প্রীতিভাজনেষু
Hatred is one of the passions that can master a life, and there is a temperament very prone to it, ready to see life in terins of vindictive melodrarna, ready to fine stimulus and satisfaction in frightful dem onstrations of ‘justice’ and ‘revenge’. – H.G. wells
.
কালো জিন এবং শাদা জিন বৃত্তান্ত
দায়রা জজ ফাঁসির হুকুম দিলে আসামি শফিউজ্জামানের একজন কালো আর একজন শাদা মানুষকে মনে পড়ে গিয়েছিল। এদেশের গ্রামাঞ্চলে শিশুরা চারদিকে অসংখ্য কালো মানুষ দেখতে-দেখতে বড় হয় এবং নিজেরাও কালো হতে থাকে। কিন্তু শাদা মানুষ, যার নোম ভুরু ও চুলও প্রচণ্ড শাদা, ভীষণ চমকে দেয়।
এর আগে শফিউজ্জামান ‘বিপজ্জনক ব্যক্তি’ ঘোষিত হন। একবার তাঁকে সাত বছরের জন্য জেলা থেকে নির্বাসিত করা হয়। ইংরেজের আইন একেক সময়ে ভারি অদ্ভুত চেহারা নিত।
কিন্তু শফিউজ্জামান ছিলেন আরও অদ্ভুত। কারণ তাঁর পিতা ছিলেন মুসলিমদের ধর্মগুরু। শিষ্যরা তাঁকে বুজুর্গপির বলে মনে করত, যদিও পিরতন্ত্রের বিরুদ্ধে তিনিই জেহাদ করে বেড়াতেন মুলুকে-মুলুকে। তাঁর পুরো নামটি প্রকাণ্ড। সৈয়দ আবুল কাশেম মুহম্মদ বদি-উজ-জামান আল হুসায়নি আল-খুরাসানি।
বদিউজ্জামান ছিলেন যেমন অমায়িক, মিষ্টভাষী আর ভাবপ্রবণ, তেমনি খামখেয়ালি, জেদি আর হঠকারী। বারবার ঠাঁইনাড়া হওয়া ছিল স্বভাব। শফিউজ্জামানের জন্ম কাঁটালিয়া নামক পদ্মাতীরবর্তী এক গ্রামে। যখন তাঁর তিন বছর বয়স, তখন বদিউজ্জামান গেরস্থালি তুলে নিয়ে পোখরায় যান। শফির পাঁচ বছর বয়সে পোখরা থেকে বিনুটি-গোবিন্দপুর, দশ বছর বয়সে নবাবগঞ্জ, বারো বছর বয়সে কুতুবপুর, ষোলতে খয়রাডাঙ্গা, আর পরের বছরই মৌলাহাট। শফির জন্মের আগেও এরকম ঘটেছে। তার মা সাইদ-উন-নিসা, সংক্ষেপে সাইদা, সেইসব। ঘটনা শফিকে হয়তো অনেকটা রঙ চড়িয়েই শোনাতেন। প্রথম স্টিমার দেখা ও ইলিশ খাওয়া আর প্রথম জঙ্গলের বাঘের মুখোমুখি হওয়ার রোমহর্ষক গল্প। একবার গোরুর গাড়িতে টাপরের পেছনকার পরদা তুলে হাত বাড়াচ্ছেন আর হাতে কচি আম ঠেকছে, এত আমের গাছ রাস্তার দুদিক থেকে ঝুঁকে এসেছে টাপরের ওপর। সেই আম খেতে খেতে শেষে পেটে নাড়ি কচলানো ব্যথা। বুজুর্গ স্বামীর দেওয়া পড়ে ফুঁ দেওয়া জল খেয়েই শেষে সেরে গেল। সারবে না কেন? মৌলানার সঙ্গে আসমান থেকে জিনেরা নিশুতি রাতে দলিজঘরে দেখা করতে আসত। জানলা দিয়ে ঠিকরে পড়ত শাদা রোশনি। জিনেদের কণ্ঠস্বর ছিল গ্রামোফোন রেকর্ডের মতো অর্থাৎ ধাতব ও সঙ্গীতময়। তাদের ভাষা সাইদা বুঝতেন না। তাঁর শাশুড়ি মাঝরাত্তিরে বউবিবিকে জাগিয়ে দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলতেন, জিনের সঙ্গে বদুর বাত করা শুনতে চেয়েছিলে। ওই শোনো! সাইদা তখনও নাকি বালিকা। তাঁর স্বামীর বয়স তাঁর বয়সের আড়াইগুণ প্রায়। সাইদা বলতেন, আমাকে একবার জিন দেখাবেন বলায় উনি রাগ করে এক হপ্তা ‘ইত্তেকাফ’ নিয়েছিলেন।
‘ইত্তেকাফ’ শফি দেখেছেন। ব্যাপারটা আসলে নির্জনে মৌনীভাবে ঈশ্বরচিন্তা। কিন্তু বদিউজ্জামান তো পাহাড় বা অরণ্য এলাকার বাসিন্দা ছিলেন না যে পাহাড়ের গুহায় বা জনহীন জঙ্গলের ভেতর কুটির করে এক সপ্তাহের খাদ্য ও পানীয় নিয়ে ঈশ্বরচিন্তায় বসবেন। তিনি যেতেন মসজিদে। সব মসজিদই এদেশে পূর্বদুয়ারি। দক্ষিণপূর্ব কোনায় মশারি খাঁটিয়ে ঢুকে পড়তেন। মুসল্লি শিষ্যরা ওই কয়েকটি দিন যতটা সম্ভব নিঃশব্দে নমাজ পড়ে যেত। নৈলে মসজিদ তো নমাজান্তে সামাজিক আলোচনার মজলিশ, কখনও বিচাবসভাও। সেকারণে হই-হট্টগোলও চূড়ান্ত রকমের হয়ে থাকে। হুজুর ‘ইত্তেকাফ’-ব্রত নিলে তারা তাঁকে বরং সাহায্য করত। মসজিদ এলাকায় জোরে কথা বলতে দিত না কাউকে। লোকচক্ষুর অন্তরালে একটি কালো মশারির ভেতর আব্বা হারিয়ে গেলে বালক শফি খুব অবাক হয়ে যেত। তার বড়ভাই নুরুজ্জামান সুদূর দেওবন্দ মাদ্রাসায় তালেব-উল-আলিম –শিক্ষার্থী। মেজভাই মনিরুজ্জামান জন্ম-প্রতিবন্ধী। মুখ দিয়ে লালা বেবুত। নড়বড় করে পাছা। ঘষটে উঠোন থেকে বারান্দা, বারান্দা থেকে ঘর, শেষে রান্নাশালে গিয়ে মায়ের পিঠে সেঁটে যেত। তাই শফিকেই আব্বার খাবার পৌঁছে দিতে হতে মসজিদে। একে তো মসজিদের ভেতর আবছায়া, তাতে ওই কালো মশারি। খাবার পাশে রেখে শফি চোখদুটো তীক্ষ্ণ করে ভেতরটা দেখতে চাইত। আব্বার সঙ্গে কথা বলা বারণ। বললেও তিনি জবাব দেবেন না। কিন্তু শফিব ইচ্ছে করত, মশারিটা একবার খপ করে তুলে দেখেই পালিয়ে যায়।