- বইয়ের নামঃ ৫০টি প্রেমের গল্প
- লেখকের নামঃ সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ পারুল প্রকাশনী প্রাইভেট লিমিটেড (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
আলো-অন্ধকার
এক-একটা দিন ভোলা যায় না। জীবনে সেই সব দিন যেন নোঙর করা নৌকোর মতো স্মৃতির ভারে দুলতে থাকে। একটু দেরি হল অফিসে পৌঁছোতে। আজকাল আর সময়কে কোনও কিছুতেই মাপা যায় না। সময়ের হিসেবে স্থানের দূরত্ব যেন বেড়েই চলেছে। একই যানবাহনে এই একই জায়গা থেকে আগে যে সময়ে ডালহৌসি পৌঁছোতুম এখন তার চেয়ে অনেক বেশি সময় লাগে। এর একাধিক কারণ। আমরা যে অঞ্চলে রয়েছি সেখান থেকে অনিবার্য কারণে অনেক সুযোগ-সুবিধেই ক্রমশ অন্তর্হিত হচ্ছে। একটা বড় বা প্রধান বাসরুট উঠে গেছে। অন্যান্য বাসের সংখ্যাও অনেক কমে গেছে। দুধ পাওয়া যায় না। পোস্টঅফিস নেই। বাজারের অবস্থাও খারাপ। জিনিসপত্রের চালান নেই। স্কুল, কলেজ অনিয়মিত। মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ নেই বললেই চলে, সকলেই গৃহের গণ্ডিতে অন্তরিন। আজকাল দেরিতে অফিস পৌঁছেলে কেউ কিছু মনে করে না। কারণ সব কিছুই অনিশ্চিত! সকলেরই এক অবস্থা। বলতে গেলে—ফাদার উই আর অন দি সেম বোট।
অফিসে পৌঁছে আজকাল আর প্রস্তুতির সময় পাওয়া যায় না। ঢুকেই কাজ নিয়ে বসতে হয়। কোনও কোনওদিন এক ঘর ভিজিটার নানা সমস্যা নিয়ে মুখিয়ে বসে থাকে। পোর্টফোলিও এক কোণে ফেলেই কাজের স্রোতে নিজেকে ছেড়ে দিতে হয়। এর মাঝে একমাত্র রিলিফ— মলয় এক কাপ চা যখন দিয়ে যায়। চুমুকে চুমুকে চা খেতে খেতে মাঝে মাঝে আকাশের দিকে তাকানো—পনেরো-কুড়ি মিনিটের জন্যে অন্য জগতে, কল্পনার জগতে মুক্তি। টেলিফোন বেজে উঠল। চায়ের সময় ফোন বড় বিরক্তিকর। তবুও রিসিভার তুলতে হল। ও প্রান্তে কাবেরী। কী হল! এই তো মাত্র দু-ঘণ্টা আগে তাকে ছেড়ে এলাম। কী হল কাবেরী? একটু তাড়াতাড়ি চলে আসব! আচ্ছা, তুমি যদি এইরকম করো, কাজকর্ম কী করে করব! লোকে আমাকে স্ত্রৈণ বলবে যে। আচ্ছা আজকের দিনটা। বেশ তাই হবে। কিন্তু নট বিফোর ফোর।
একটা জরুরি ডেসপ্যাঁচ ছিল। তাড়াতাড়ি শেষ করে ফেললুম। দুটো নোট পাঠিয়ে দিলুম বড়কর্তার ঘরে। এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক এলেন তাঁর মেয়েকে নিয়ে। মেয়েটির বয়স বেশিনয়। এমন করুণ চেহারা যে দেখলেই মায়া হয়। ভদ্রলোক বছরখানেক আগে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন। তারপর বিপর্যয়। এখন মেয়েকে কোনও হাতের কাজ শিখিয়ে স্বাবলম্বী করতে চান। মনে যে ঝড় বইছে তা তো আর কমানো যাবে না, এখন দেহটাকে বাঁচাবার ব্যবস্থা করতে হবে। কিছু আন্তরিক ব্যবস্থাপত্র দিলেও, কাজ কী হবে বলা শক্ত। কিন্তু বৃদ্ধ খুশি হয়ে চলে গেলেন। আশা এমন জিনিস, কিছু একটা হতে পারে এই চিন্তায় তিনি হয়তো কয়েক দিন স্বপ্ন দেখে কাটিয়ে দেবেন।
কাবেরীকে কথা দিয়েছি—একটু আগে বেরোব। সুতরাং, কাজ সারতে হবে চটপট। এর পর সামান্য কিছু কেনাকাটাও আছে। আমার সেই ছোট্ট ফ্ল্যাটের আকর্ষণ প্রকৃতই অসাধারণ। সাজানো-গোছানো, ছিমছাম। কাবেরীর শিল্পীমনের ছাপ সর্বত্র। পরদা থেকে শুরু করে বিছানার চাদর, টেবলক্লথ, সোফাসেটের ঢাকা এক রঙের। পালিশ করা অল্পসল্প ফার্নিচার। জাপানি। কায়দায় ফুল সাজানো। দেওয়ালে কয়েকটি নির্বাচিত জায়গায় কাবেরীর নিজের আঁকা, জল এবং তেল রঙের বিভিন্ন স্টাডি। আমার নিজের সংগ্রহশালার কিছু কিছু ছবি। শিল্পসমালোচক হিসেবে আমার নিজের সংগ্রহও বেশ সমৃদ্ধ হয়ে উঠছে। এই ছবি দিয়েই আমাদের পরিচয়ের শুরু। অ্যাকাডেমিতে কাবেরীর একক চিত্রপ্রদর্শনীতে আমাদের প্রথম আলাপ। শেষ আমার ফ্ল্যাটে। নিঝঞ্চাট, নির্বিবাদী মানুষ না হলেও শিল্পসত্তা একটা আছে, স্ত্রী একজন রুচিসম্পন্না প্রকৃতই যশস্বী শিল্পী। যোগাযোগ অদ্ভুত। ভাগ্য দেখে হিংসে করলে কিছু করার নেই। সবই ভবিতব্য। তবে আমি এইটুকুই জেনেছি, জীবন থেকে এই পাঠই নিতে পেরেছি সুখ আর দুঃখ চাকায় বাঁধা, জীবনে ঘুরে ঘুরে আসে। উৎফুল্ল হওয়ার কিছু নেই। একটা মুক্ত অনাসক্ত মন নিয়ে চলতে হবে।
সাড়ে তিনটে। এবার বেরোতে হবে। দিনের কাজ শেষ। কয়েকদিন দেখছি কাবেরী সঙ্গ চাইছে। ভীষণ মুডি মেয়ে। যখন ছবি নিয়ে থাকে তখন তার সেই জগতে আমার প্রবেশ নেই। আমায়। হঠাৎ হয়তো ডেকে নেবে। দেখো তো কেমন হচ্ছে সমালোচক মশাই! ইজেলের ধারে দাঁড়ানো তার দীর্ঘ শরীর, হাতে তুলি, রঙিন শাড়ি, তেলহীন অবিন্যস্ত চুলের ঢল পিঠে ভেঙে পড়েছে সে তখন নিজেই একটা ছবি। কাকে দেখব? ক্যানভাসের ছবি না জীবন্ত ছবি! তখন স্বভাবতই একটু অন্যরকম আবেগ মনের মধ্যে টগবগ করে ওঠে। দুজনের নিভৃত সংসারে স্থান, কাল, পাত্রের তো কোনও বাধা নেই। কাবেরী হয়তো একটু মৃদু আপত্তি জানায়। সে আর কিছু নয়, ব্যাপারটাকে আরও একটু আকর্ষণীয়, উদ্বেল করে তোলা। আমি তখন বলতে চাই—দিস ইস। লাইফ মাই ডিয়ার লেডি! তখন সেই অফিস অথবা জীবনসংগ্রাম কিংবা শহরজীবনের কাটাকাটি, হানাহানি, অথবা রাজনীতি ইত্যাদি অনেক দূরে। যেমন সমুদ্রের গর্জন। কানে আসছে কিন্তু যেহেতু জলে নামিনি সেইহেতু যেন একটা অন্য স্বাদ। সব মিলিয়ে জীবন।