- বইয়ের নামঃ দূরবীন
- লেখকের নামঃ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০০১. হেমকান্ত চৌধুরী
১৯২৯ সালের শীতকালের এক ভোরে হেমকান্ত চৌধুরীর হাত থেকে দড়ি সমেত কুয়োর বালতি জলে পড়ে গেল। অসহনীয় শীতের সেই নির্জন ব্রাহ্মমুহূর্তে অন্ধকারে হেমকান্ত অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে শুনলেন জলে দড়ি ও বালতির পড়া ও ড়ুবে যাওয়ার শব্দ। তার জীবনে এরকম ঘটনা এই প্রথম।
একটু দূরে উঁচু বারান্দার ধারে হ্যারিকেনটা রাখা। তার আলো কুয়োর পাড়ে খুব ক্ষীণ হয়ে আসছে। হেমকান্ত সেই একটুখানি আলোয় নিজের দুখানা হাতের পাতার দিকে চেয়ে দেখলেন। এই বিশ্বস্ত হাত থেকে গতকাল পর্যন্ত কখনও কুয়োর বালতি পড়ে যায়নি।
হেমকান্ত বিস্ময় ও অবিশ্বাসভরে নিজের দুখানা হাতের দিকে চেয়ে রইলেন অনেকক্ষণ। তারপর সিদ্ধান্তে এলেন, তিনি বুড়ো হয়েছেন। যথেষ্ট বুড়ো।
বাড়িতে দড়ি আছে, বালতি তোলার কাঁটাও মজুত। ইচ্ছে করলে হেমকান্ত কেউ জানবার আগেই বালতিটা তুলে ফেলতে পারতেন। কিন্তু সে চেষ্টা আর করলেন না। কেনই বা করবেন? জীবনের অনেক কাজকেই আজকাল তার তুচ্ছ বলে মনে হয়।
১৯২৯ বা তদানীন্তন কালে বয়স ত্রিশ পেরোলেই গড়পড়তা বাঙালি পুরুষ নিজেকে বুড়ো। ভাবতেন। পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ বছর বয়সে অনেকেরই নাতি-নাতনি হতে শুরু করত। কাজেই নিজেকে বুড়ো ভাবার দোষ ছিল না। সেই হিসেবে হেমকান্তকেও বুড়োর দলে ফেলা যায়। ঘটনার সময় তার বয়স কমবেশি পঁয়তাল্লিশ। উনিশ বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয় কিশোরগঞ্জের মোক্তার সুধীর চক্রবর্তীর মেজো মেয়ে সুনয়নীর সঙ্গে। পঁয়ত্রিশ বছর বয়সেই তিনি ছয় সন্তানের জনক হন। সাঁইত্রিশে বিপত্নীক। তার জ্যেষ্ঠ পুত্র কনককান্তির বয়স চব্বিশ। বিবাহিত এবং দুই সন্তানের পিতা। মেজো সন্তান মেয়ে সবিতা। তার বরিশালে বিয়ে হয়েছে। তৃতীয় জন ছেলে জীমূতকান্তি। সেও বিবাহিত, তবে সন্তান হয়নি। চতুর্থ ও পঞ্চম পর পর দুই মেয়ে ললিতা ও বিশাখা। ললিতার বিয়ে দিয়েছেন কলকাতায়। ষষ্ঠটি পুত্র সন্তান। বয়স দশের বেশি নয়। তার নাম প্রথমে রাখা হয়েছিল কৃষ্ণকান্তি। হেমকান্ত পরে নিজের নামের আদলে কান্তির বদলে কান্ত যোগ করায় এখন সে কৃষ্ণকান্ত। বিশাখা ও কৃষ্ণকান্ত ছাড়া হেমকান্তর কাছে কেউই থাকে না। প্রকাণ্ড বাড়ি হা-হা করছে। আছে বিশ্বস্ত কয়েকজন দাস-দাসী, একটা বশংবদ দিশি হাউন্ড জাতীয় সড়ালে কুকুর। একটা বুড়ো ময়ূর। কয়েকটা পোষা পাখি। গোটা দশেক গোর। কয়েকটা কাবলি বেড়াল।
জমিদার-সুলভ কোনও বদ অভ্যাস হেমকার বংশে কারও নেই। হেমকান্তও সেসবের ঊর্ধ্বে। মদ ছেন না, বাইজি নাচান না, ইয়ারবন্ধুও বিশেষ নেই। এমনকী পাশা তাস ইত্যাদিরও নেশা নেই তার। বড় ভাই বরদাকান্তর বাল্যকাল থেকেই একটা উদাসী ভাব ছিল। যৌবনে ভাল করে পা দেওয়ার আগেই সে একদল সন্ন্যাসীর সঙ্গে ভিড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। বরদাকান্তর পরিত্যক্তা স্ত্রী প্রভা ঢাকায় তার বাপের বাড়িতে আজও জীবন ধারণ করে আছেন। কেমন আছেন তা হেমকান্ত জানেন না। তার ছোট এক ভাই ছিল। নলিনীকান্ত। তার পরোপকারের নেশা ছিল। ব্রহ্মপুত্রে এক ঝড়ের রাত্রে তার নৌকাড়ুবি হয়। নৌকোর অন্যান্য যাত্রীরা বেঁচে গেলেও নলিনীকান্তর লাশ পাওয়া যায় ঘটনাস্থল থেকে তিন মাইল উঁটিতে। তিন ভাইয়ের স্বভাবেই মিল আছে। কেউই খুব বিষয়াসক্ত নন। এসরাজ বাজানো ছাড়া হেমকান্তর কোনও আমোদ-প্রমোদও নেই। একসময়ে ফুটবল খেলতেন। ব্যস, আর কিছু নয়। তিনি স্বাবলম্বী, আত্মনির্ভরশীল, শান্ত ও হিসেবি মানুষ। কোনও ব্যাপারেই তিনি অসতর্ক নন। তাঁর জমিদারি খুব বড় নয়। অন্যান্য জমিদারের তুলনায় তিনি নিতান্তই চুনোখুঁটি। তবে হেমকান্ত কারও সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার চেষ্টা করেন না। তাঁর চাল-চলতিও জমিদারের মতো নয়। দাপট নেই, রাগ নেই, কর্তৃত্ব নেই। তাঁর কথা কম, হাসি কম, ভালবাসা বা আবেগও নগণ্য।
হেমকান্ত হ্যারিকেনটা বাইরে রেখে ঘরে ঢুকলেন। অন্যান্য দিন এই সময়ে তিনি আহ্নিক করতে বসেন। আজ বসলেন না। তাঁর শান্ত ও ভাবলেশহীন মন আজ কিছু চঞ্চল। বিলিতি টেবিল ল্যাম্পের সলতে ধরিয়ে তিনি বসলেন বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করতে।
ইহাই কি বার্ধক্য নহে? পেশির দৌর্বল্য দেখা দিয়াছে, স্নায়ু আর আগের মতো সতেজ নাই। ক্রমে ক্রমে স্থবিরতা আসিবে। আয়ু ফুরাইবে। যৌবনে প্রায় কেহই মৃত্যুকে ভয় করে না। কিন্তু রক্তের তেজ কমিয়া আসিলে দিনান্তে একা বসিয়া প্রিয় ও মৃতদের কথা ভাবিতে গিয়া কখন যেন পৃথিবীর সহিত আসন্ন বিরহের কথা মনে করিয়া হৃদয় ভাবাক্রান্ত হইয়া উঠে। সেদিন কোকাবাবুকে দেখিতে গিয়াছিলাম। উদুরিতে পেটটা ফুলিয়া ঢাক হইয়াছে। পিঠভরা বেডসোর। হাঁ করিয়া কষ্টে খাস লইতেছেন। একেবারে শেষ অবস্থায় তাঁহাকে বাড়ির পিছন দিকে একটি ঘরে স্থানান্তরিত করা হইয়াছে। ঘরে ঢুকলেই মনে হয় চারিদিক মৃত্যুর বীজাণুতে ভরা। ঘরের এক কোণে একটি ভাড়াটিয়া কীর্তনীয়া ছোট্ট করতাল লইয়া ক্লান্ত ও যান্ত্রিক স্বরে তারকব্রহ্ম নাম করিতেছিল। গুণ্ঠনবতী এক দাসী কেবল তাহার পরিচর্যা করিতেছে। বাহিরের ঘরে তাহার দুই পুত্র উদ্বিগ্ন মুখে বসা। মেয়েরাও আসিয়াছে। কান্নাকাটিও কিছু কিছু চলিতেছে। কোকাবাবুর স্ত্রী চিররুগ্না। তাহাকে আমি বিশেষ হাঁটাচলা করিতে দেখি নাই। সেদিনও তিনি শয্যাশায়িনী ছিলেন। কোকাবাবুর জন্য যে বিশেষ শোক অনুভব করিতেছিলাম তাহা নহে। তাহার যথেষ্ট বয়েস হইয়াছে। কিন্তু সেই সময় একটি ঘটনায় সমস্ত চিত্রটিরই এক অন্যরূপ অর্থ প্রতিভাত হইল। কোকাবাবুর নাতি শরৎ অকস্মাৎ এক হাতে বন্দুক ও অন্য হাতে গোটাকয় মৃত বেলেহাস লইয়া ঘরে প্রবেশ করিল। বলিল, চর থেকে মেরে আনলাম বাবা, আজ আর খালিহাতে ফিরিনি। তোমাকে কী বলিব। সেই ঘোষণায়। এবং বেলেহাঁস দেখিয়া বাড়ির লোকজনের মধ্যে যেন একটা উত্তেজনা বহিয়া গেল। শরৎ কিশোর বয়স্ক। তাহার টিপ যে কী সাংঘাতিক হইয়াছে এবং তার সাহসও যে কত তাহাই তাহার বাবা গগন আমাকে বুঝাইতে লাগিল। শুনিতে শুনিতেই টের পাইলাম, ভিতরবাড়িতে বেলেহাঁস তরিবৎ করিয়া রাঁধিবার নানা তোড়জোড় চলিতেছে। কয়েক মুহূর্তের জন্য যেন কোকাবাবুকে সকলেই ভুলিয়া গেল। বার্ধক্যে ও মৃত্যুতে যে মানুষ কতটা একা ও নিঃসঙ্গ তাহা সেদিন বুঝিলাম। এও বুঝিলাম কোকাবাবুর আত্মীয়-পরিজনের মুখে যে উদ্বেগ ও আগাম শোকের ছাপ পড়িয়াছে তাহার সবটাই খাটি নয়, ছদ্মবেশও আছে। সেইদিনই মনে প্রশ্নের উদয় হইল, আমাদের প্রিয় পরিজনদের মধ্যে যে ভালবাসা সমবেদনা ও প্রেম দেখিতে পাই তাহার অনেকটাই বোধহয় আমাদের চোখের ভ্রম। সচ্চিদানন্দ, এবার একবার লম্বা ছুটি লইয়া আস। তোমারও আমার মতোই বয়স হইয়াছে। জীবনের মেকি ও খাঁটিগুলিকে বাছাই করার জন্য তোমার সঙ্গে দীর্ঘ পরামর্শ আছে।… পরদিন এই চিঠি হেমকান্ত লেখেন তার আবাল্য সুহৃদ সচ্চিদানন্দ বিশ্বাসকে।