- বইয়ের নামঃ বিধ্বস্ত নিলীমা
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- প্রকাশনাঃ বিভাস
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অপচয়ের স্মৃতি
“দেখে নিও আমি মহাপুরুষের ভূমিকায় ঠিক
উৎরে যাবো একদিন। হবো তথাগত কিংবা যীশু,
দগ্ধীভূত আত্মায় ফেলবে ছায়া কোনো বোধিদ্রুম।
ফন্দিবাজ জনরবে কান দিয়ে, জিঘাংসায় মেতে
চেনা দেশে করবো না প্রতারিত শান্তির পাখিকে
চতুর মিলিত ফাঁদে। পথে হাঁটে জীবিত মানুষ,
ভালবাসে পৃথিবীর তাপ, রাত্রিবেলা পুত্র ভয়ে
চেঁচিয়ে উঠলে ঘুমে জোরে বুকে চেপে ধরে তাকে-
ঘৃণার ত্রিশূলে তাকে কী করে বিঁধবো অকাতরে?
“হে পিতৃপুরুষবর্গ তোমাদের মিলিত শোণিত
বিষণ্ণ বংশের রক্তে জাগায় প্রতীকী শিহরণ
মতবাদ-পীড়িত যুগের গোধুলিতে। সংবর্ধনা
পায় তারা নষ্ট বাগানের স্তব্ধতায়, বিষাদের
ইন্ধন জোগায় নিত্য পক্ষাঘাতগ্রস্ত, সময়ের
কাৎরানি মূঢ়তা আর মিথ্যাচার, যা-কিছু নিশ্বাসে
অগোচরে সহজে মিশিয়ে দেয় বিন্দু বিন্দু বিষ।
“যে স্মৃতি ভ্রাতৃহননে প্ররোচিত করে বার বার
প্রেতায়িত মন্ত্রণায়, সে-স্মৃতির কর্কশ চিৎকারে
কেঁপে ওঠে গৃহস্থালি ভয়-পাওয়া পায়রার মতো,
বন্ধু হয় জানালা কপাট, তাড়া খেয়ে দিন ঢোকে
রাত্রির গুহায়, অমঙ্গল খিল খুলে আঁধিঝড়ে
সদম্ভে বেরিয়ে পড়ে চৌরাস্তায়-আমি সুনিশ্চিত
দায়ভাগী তার। চিরন্তনী অপচয় আমাদের
সব স্বপ্ন নষ্ট করে, চোখ জুড়ে থাকে কিমাকার
জন্তুর কংকাল কোনো। ধ্বংসস্তূপ ফুলে ঢেকে আমি
বিষাদের গাথা লিখি শ্রীযুক্ত বিষণ্ণ পরিমল।
“খাবার টেবিলে বসে মেজাজ খারাপ করে আমি
সান্ত্বনাদায়িনী মাকে বলি শিশু নই, কাঁহাতক
খোকা সেজে থাকা যায় অবিচল স্নেহের নকশায়!
আমার অনেক কাজ। পৃথিবীটা দৃশ্যকাব্য হলে
ছিল না ঝামেলা মোটে, মহিমার শিরস্ত্রাণ পরে
বস্তুপুজ্ঞে দিতাম মিশিয়ে ঢের রহস্যময়তা।“
“বাচাল প্রিন্টিং প্রেস জয়োল্লাসে দিচ্ছে জন্ম আজ
যে-উচ্ছিষ্ট সভ্যতাকে আমি তার ম্লান, স্বরহীন
ক্রীড়নক হবো শুধু? আমার মগজে সারাক্ষণ
প্রকাণ্ড, উজ্জ্বল এক রাজহাঁস পাখা ঝাপটায়,
কেবলি হোঁচট খায় দেখি স্বপ্নলোকের চৌকাঠে।
ধাতুর চত্বরে বসে অজস্র পেরেক ঠোকে কারা
শক্ত কাঠে সর্বক্ষণ, স্বপ্নে দেখি, নৈরাজ্যে অস্থির
প্রসিদ্ধ গ্রন্থের সব মহান হরফ মুছে যায়,
চতুর্দিকে মুণ্ডহীন মানুষের অখণ্ড স্বরাজ!
ফুটপাথে হন্তারক হাওয়ার শাসানি পরিমল
বোঝেনি বস্তুত তাই যখন পৈশাচী অন্ধকারে
ভায়ের উৎকট গন্ধ নেকড়ের মতো হিংস্রতায়
শরীরে ঝাঁপিয়ে পড়ে, দৃষ্টি-অন্ধ-করা রক্ত দেখে
থমকে চায়, চোখ জুড়ে থাকে স্থির এক অবিশ্বাস,
(রাজহাঁস মুখ থুবড়ে পড়ে নর্দমায়) পৃথিবীতে
সম্প্রতি কোথাও নেই শ্রীযুক্ত বিষণ্ণ পরিমল!
আত্মজৈবনিক
যুদ্ধবাজ সাইরেনে উচ্চকিত কৈশোর আমার
গলির বিধ্বস্ত ঘরে। গুলির শব্দের প্রতীক্ষায়
কেটেছে ভুতুড়ে রাত্রি অন্ধকারে এবং তামার
মতো দিন খাকির প্রতাপে কাঁপে শান্তির ভিক্ষায়।
যৌবন দুর্ভিক্ষ-বিদ্ধ, দাঙ্গাহাঙ্গামায় ভাঙে দেশ,
এদিকে নেতার কণ্ঠে নির্ভেজাল স্বদেশী আকুতি
ভাষা খোঁজে। আদর্শের ভরাডুবি, মহাযুদ্ধ শেষ,
মঞ্চ তৈরিঃ কে হবে নায়ক তবে? করি কার স্তুতি?
সগৌরবে ঢাক-ঢোল বাজালো সে ধ্বংসের উৎসবে
যারা তারা কেউ পেলে শিরোপ, কেউবা পতনের
ঝাঁ-ঝাঁ স্মৃতি; বহু মাঠ গেলো ভরে নামহীন শবে।
পচা মাংস দেখে দেখে ক্লান্ত হয়ে বেশ্যার স্তনের
উষ্ণতার মনস্তাপ মাখে যে- লোকটা মগজেই
ঘোরে তার শবাধার, একগাছি দড়ি কিংবা ক্ষুর-
যা-কিছু হননপ্রিয়, যা-কিছু অত্যন্ত সহজেই
জীবনকে করে তোলে অর্থহীন জীর্ণ আস্তাকুঁড়।
চতুর বক্তৃতাবলী, প্রচারণা, সংঘের ধূর্তামি
ছাড়া কল্কে পাওয়া ভার! বুক বেঁধে নির্বোধ সাহসে
বিবর্ণ স্যাণ্ডেল পায়ে ঘুরেছি ধুলোয় রোজ আমিঃ
হা-ঘরে বন্ধুর খোঁজে কতদিন বেড়িয়েছি চষে
সারাটা শহর। অন্ধকারে কতো আনোরারা, বামী
ইতস্তত গেছে ডুবে- দেখেছি স্বচক্ষে আর কষে
দিয়েছি বিড়িতে টান একাকিত্বে যখন তখন।
স্বরণের আঠা দিয়ে হতাশ প্রেমের জলছবি
সেঁটেছি সত্তার ফ্রেমে। মধ্যপথে কেড়েছেন মন
রবীন্দ্রঠাকুর নন, সম্মিলিত তিরিশের কবি।
কখনো শুনিনি পার্কে বসে হরিণের ডাক কিংবা
পরীর আশ্চর্য স্তন আনেনি মোহের জ্যোৎস্না চোখে,
জানালার শক্ত শিকে কোনোদিন। নিজেকে প্রতিভা-
বান ভেবে ঘেঁটেছি নন্দনতত্ত্ব, যা বলুক লোকে
স্বপ্নে শুধু হাঁসের ঝাপট দেখি কশাইখানায়ঃ
মনে হয় স্ট্রেচারের ক্যানভাসে পড়ে আছি একা,
কানে আসে কানাঘুষো, যেতে যেতে কে যেন জানায়ঃ
এইতো বেজেছে ঘণ্টা, হবে না কখনো আর দেখা।
বতিচেলী নারী নয়, মাতিসের রমণীর মতো
তেমন কাউকে নয়, যে-হোক সে-হোক নারীকেই
পাশে নিয়ে রাস্তায় হাঁটবো ভেবে সুখে অবিরত
হঠাৎ নিজেরাই পায়ে মেরেছি কুড়াল। মেরে খেই
হারিয়েছি জীবনের। মধ্যে মধ্যে ইচ্ছে হয় বলি
জীবন, থামোহে বাপু, শুনেছি তোমার বাচালতা
অনর্গল বহুদিন; এবার দিয়েছি জলাজ্ঞলি
মেরুদণ্ডহীন, ক্লীব আশাকে তোমার। যে ব্যর্থতা
আমাকে শাসায় নিত্য, আমি তারই অগ্নিকুণ্ডে জ্বলি।
তোমরা আসবে কেউ? খোঁজো যারা ক্ষিপ্র সার্থকতা!
যেহেতু যথেষ্ট নই ভদ্রলোক তাই জবুথবু
সমাজের মোড়লেরা যথারীতি করেছে বিদায়
ওহে অর্ধচন্দ্র দিয়ে। কোনোমতে সামলে নিয়ে তবু
প্রতিবাদ করবো কি করবো না, পড়েছি দ্বিধায়।
একদিন নিত্যসঙ্গী ছিল যারা তারা ডানে বামে
সরে পড়ে, আমি শুধু যাইনে কোথাও। চোখে ভ্রম,
আরেক যুদ্ধের ছায়া যৌবনের অপরাহ্ণে নামে
এবং জীবন জানি সারাক্ষণ সিসিফস-শ্রম।