- বইয়ের নামঃ উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- প্রকাশনাঃ বিভাস
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অনিবার্য ঘরে ফেরা
এইমতো স্থিতি তার, স্পন্দনরহিত সর্বক্ষণ,
পতিত ফলের মতো ম্লান।
এভাবেই থাকে সে প্রায়শ
রাত্রিদিন এমন নিঃসাড়
পারিপার্শ্বিকের
প্রতি উদাসীন।
টেলিফোন বাজে,
বেজে চলে ক্রমাগত বেলা অবেলায়;
পোস্টম্যান, বালকের রঙিন মার্বেল
অথবা উড়ন্ত ঘুড়ি, উদ্ভিন্ন মল্লিকা,
সোমত্ত গাছের
বাকলের ঘ্রাণ,
অকাল বৃষ্টির জুঁই-
কিছুই পারে না তার শিরায় জাগাতে কোনো গান।
এভাবেই থাকে; রৌদ্র লাগে গালে, স্বেচ্ছাচারী জ্যোৎস্না
ধুয়ে দ্যায় মুখ, অথচ সে আপাতত
একটি খোলস শুধু।
সাংকেতিক ভাষার মতন
আছে স্থির সারাক্ষণ কণ্ঠস্বরহীন
এবং এখন কে বলবে করেছে সে
রোপণ বিস্তর
স্বপ্নবীজ ছন্নছাড়া মাঠে পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া?
কে বলবে তার আঙুলের চকিত ছোঁয়ায় নারী
হয়ে যায় স্মরণীয় নিবিড় লিরিক?
কোন ইন্দ্রজালে
সহসা খোলস ছিঁড়ে জেগে ওঠে অন্য একজন
কেমন সহজ ভঙ্গিমায়,
যেনবা বিপথগামী পথিকের ভালোয় ভালোয়
বেলাশেষে এক অনিবার্য ঘরে ফেরা।
আমার নিবাস
কখনো গিয়েছি আগে সেখানে, মানে সে বহুদূরে
মফস্বলী পুরানো মহলে?
দুপুর, নিবিড় হয় চোখের পাতায় আর উদাস পুকুরে;
সিঁড়িতে পা রাখতেই উষ্ণ করতলে
তার হাত চলে আসে। কার? আজ ছায়াচ্ছন্ন নিস্তব্ধ দুপুরে,
নিসর্গের অন্তঃপুরে
গাছগাছালির
মাঝে দৈববলে
সহসা পেয়েছি যাকে, তার? নাকি ভুলে-যাওয়া কোনো পাঁচালির
সুন্দরীতমার? সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাই, পাশে হাঁটে
আমার জাগর স্বপ্ন শাড়ির আঁচলে
নিয়ে অতীতের ঘ্রাণ। কে যেন রয়েছে বসে শ্যাওলাঢাকা পুকুরের ঘাটে
বড় একা, অস্তিত্বের ভাঁজে ভাঁজে তার
কিছু আলো, কিছু অন্ধকার।
পঞ্জিকার পাতা ওড়ে উল্টাপাল্টা, মাঝে-মধ্যে দোলে ঝাড়বাতি
প্রাচীন অট্রালিকার হঠাৎ হাওয়ায়, পাখি তার সাথী
খুঁজতে খুঁজতে ফের কী মসৃণ সবুজে লুকায়,
সে আমাকে ডাকে মনে মনে, আমি তাকে ডাকি;
শিউলিতলার ছায়া স্মৃতি খুঁটে খায়।
ঘরের ভেতরে ইতিহাস অলৌকিক কলরবে
জেগে ওঠে বর্ষীয়ান কান্তিমান কথকের গাঢ় কণ্ঠস্বরে
পুরানো গানের মতো। দেয়ালে হরিণ শিং বাতিল গৌরবে
যেনবা কৌতুকপ্রদ, তাতে মায়া আছে; মায়া আছে সারা ঘরে।
বৃষ্টিগুঁড়ো দুপুরকে করে বুটিদার; মনে পড়ে
আরেক বর্ষার গান, অবিকল এই সিঁটি কবেকার, এমন চত্বরে,
মনে পড়ে, নিরিবিলি ঘরে কারো ওষ্ঠে ওষ্ঠ রেখে অমরতা
খুঁজেছি ব্যাকুল;
বুঝি তারও রাত্রিময় গহন খোঁপায় ছিল ফুল
এবং পরনে চাঁপারঙ শাড়ি, তাকেও দিয়েছি কথা,
টেনেছি বুকের কাছে, আমার ত্বকের গান বেজেছে সুদূর তার ত্বকে!
সে মুখ পড়লে মনে রক্তে লতাগুল্ম গান হয়, চোখ হয়
কণ্ঠস্বর, হস্তদ্বয় কালহীন স্পন্দিত হৃদয়,
আর মাঝে-মধ্যে মনে হয়, সব কিছু জাতিষ্মর দীর্ঘশ্বাস,
মনে হয় আমার নিবাস,
ছিল সেখানেই, সেই প্রাচীন মহলে দূর বিস্মৃত শতকে।
আমার সত্তা শ্লোক হয়ে
তোমার আমার মধ্যে ক্রমাগত রচিত হচ্ছে মাইল মাইলব্যাপী
তৃষ্ণার্ত জিহ্বার মতো গা ছমছম প্রান্তর। অদূরে
অনেক ক্ষুধার্ত শকুন
অপেক্ষমাণ, আর আমি ওদের দৃষ্টি থেকে,
শবগন্ধী চঞ্চু থেকে নিজেকে আড়াল করে হাঁটছি
ভারি পা টেনে টেনে।
কোথাও এমন কোনো পাখি নেই,
যার গানে দিকগুলি মাধুর্যের আভায় হবে রঙিন,
নেই কোনো ঝরনা, যার ছলছলে হাসি
আমার ক্লান্ত তৃষ্ণার অন্ধকারকে
মুছে ফেলবে নিমেষে।
এখন আমি তোমার দিকে মুখ রেখে এই বেয়াড়া প্রান্তর
পেরুনোর জন্যে বিশ্রামের কোটর
তছনছ করে ফেলেছি,
আমার স্বস্তি ছোঁ মেরে নিয়ে গিয়েছে এক দূরন্ত ঈগল,
তার ডানার ঝাপটা আমার নিত্যসঙ্গী।
আমি কী করে না দেখে থাকব সেই তোমাকে
যার মধ্যে মেদুর অপরাহ্নে
অলৌকিককে গ্রীবা বাড়াতে দেখেছি,
যার মধ্যে শুনেছি সুন্দর ভবিষ্যতের নিঃশ্বাস,
যার কণ্ঠে শুনেছি মৃত্যু-ভোলানো উচ্চারণ?’
আমি কী করে না দেখে থাকব সেই তোমাকে,
যার চোখ আমার প্রৌঢ়ত্বের অন্তরালে ধ্রুবতারা;
যার ওষ্ঠে সেই নদীর গান শুনি, যাকে আমি
দেখেছিলাম
অনেক আগে, সূর্যোদয় পেরিয়ে
গাছগাছালির ঘ্রাণ নিতে নিতে,
যার বুকের দ্যুতি কখনো আমাকে অন্ধ করে,
কখনোবা চক্ষুষ্মান, যার শরীরের প্রতিটি বাঁকে
সদ্য যুবার মতো মুখ রাখে আমার বাসনা?
এখন আমি আমার একাকিত্বের প্রবাসে
তলোয়ার মাছের মতো
নিয়ত সন্ধানী আর উদাস-নিষ্ঠুর।
মনে পড়ে
ঈষৎ উজ্জ্বল লাল বারান্দায় তুমি দাঁড়ানো-
আমি দেখছি তোমাকে, যেমন বয়স্ক বাজপাখি
চোখ তুলে চাঁদ। তুমি সেই মুহূর্তগুলিকে সাজালে
বিদেশী কবিতার পঙ্ক্তিমালায়;
সেই শব্দগুচ্ছে ছিল না কোনো বিদায়ী শ্লোকের বিচ্ছুরণ,
অথচ আমি বিচ্ছেদকে ডানা মেলতে দেখলাম
ঈষৎ উজ্জ্বল দীর্ঘ বারান্দায়
আমার অস্তিত্বে তোমার হাতের অন্তরঙ্গ তাপ সঞ্চয় করে
দৃষ্টিতে তুমিময় ছবি গেঁথে,
পথ চলি, ভালোবাসায় দেখি সত্যের মুখ।
দূর থেকে আমি হাত নাড়ি, তোমার স্মৃতির ভোরে বিভোর
এখন তোমার সান্নিধ্য থেকে নির্বাসিত আমি আর
অন্ধকার কুকুরের মতো
লেহন করছে আমাকে। মাঝে-মধ্যে এই রাত্রি
জন্মান্ধ গায়কের সুরে বেজে ওঠে
আমার শিরায় শিরায়, আশ্চর্য এক ফোয়ারা
আমার ভেতরে তরলিত মণিরত্ন ছড়াতে থাকে,
এবং তোমার অনেকানেক আসা-যাওয়া
স্মৃতির ঝোপঝাড়ে জোনাকি।
‘কখনো নয়, বিলুপ্তি, মনে-না-পড়া, ফিরব না’
ঝরে আমার চোখের পাতায়, স্বপ্নে তোমার শরীর
লতাগুল্মময়, পাতালে ভাসে,
আমাকে ছোঁয় তোমার কণ্ঠস্বর,
আমার সমগ্র সত্তা শ্লোক হয়ে জড়িয়ে যায়
তোমার কণ্ঠস্বরে, আমার হৃদয়
মরীচিকার মতো কাঁপে শূন্যতায়, রুক্ষ শূন্যতায়।