- বইয়ের নামঃ ইচ্ছে হয় একটু দাঁড়াই
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
ইচ্ছে হয় একটু দাঁড়াই
যখন তোমাকে দেখি তোমার নিবাসে, দেখি তুমি
বিষাদের ছায়া নিয়ে খেলা করো; আছো কিংবা নেই
বোঝা দায়। কখনো কখনো
মনে হয় যেন তুমি ছায়ার মতন জালে আটকা পড়েছো
অসহায়, চারদিক থেকে
ছুটে আসে ঝাঁক ঝাঁক ছায়ার হাঙর।
তখন আমার
বুকের ভেতরে শত শত নক্ষত্রের মৃত্যু হয়,
দাবানলে পোড়া যূথবদ্ধ ঘোড়া আর্তনাদ করে,
তুষারের কামড়ে বাগান
অন্ধ হয়ে যায় এক লহমায় আর
পুরোনো কবর খোলে মুখ ব্যাপক ক্ষতের মতো।
যখন তাকাও হেসে, হঠাৎ তোমার
বালিকা বয়স, যা’ দেখিনি আমি কখনো, আমার
ভাবনায় ভেসে ওঠে। অবচেতনায় কতিপয়
ছবি জেগে ওঠে, যেন গির্জের রঙিন কাচে গূঢ় আভাসিত
চিত্রাবলী! চাঁদ খুলে ফেলে তার নাইটি যখন,
মনে পড়ে শুয়ে আছো স্বপ্নের ডিভানে।
সংশয়ের ঘুণ
এখনো তোমাকে কুরে কুরে খায়, তুমি
তাই বিষাদের ছায়া নিয়ে খেলা করো, নাকি এই
বিষাদের নেই কোনো শেকড় বাকড়।
যখন শুনবে তুমি জানালার বাতাসের টোকা,
বুঝে নিও আমার নিঃসঙ্গ ভালবাসা ডেকে যায়
তোমাকেই তোমার মধুর নাম ধ’রে;
যখন দেখবে তুমি কোনো পাখি ছোঁয়
গাছের যৌবন, জেনো আমার সতেজ ভালবাসা
তোমাকেই ছুঁতে চায় সকল সময়;
যখন তোমার চোখে পড়বে নৌকোর
তীর-ছেড়ে-যাওয়া, বুঝে নিও
আমার জাগর ভালবাসা যাত্রা করে
তোমার দিকেই।
আমার ঘরের
প্রতিটি জানালা গ’লে রোদ আসে, হাওয়া
বয়ে যায় ক্ষণে ক্ষণে, চড়ুই যুগল ঘর বাঁধে
আমার এ ঘরে শীতে। বস্তুত এখানে
অনেকেরই আনাগোনা সকল ঋতুতে,
অথচ আমার ঘরে কোনোদিন পড়ে না তোমার পদচ্ছাপ।
ইচ্ছে হয় একটু দাড়াই
আজো ঘুম ভাঙলো সকাল সাতটায়
চিরুনীতে কাঁচা পাকা কিছু চুল উঠে এলো আজো,
ধুমায়িত চায়ের কাপের সঙ্গে এলো
খবর কাগজ।
ইচ্ছে হয় বিছানায় জলচর প্রাণীর মতন সুনসান
আরো কিছু সময় কাটা।
প্ল্যাস্টিকের বালতিতে নামে
ট্যাপের পানির কৃশ ধারা, ঘরে ভাসে
পান্নালাল ঘোষের ভৈরবী; অকস্মাৎ
দুপুরে চিলের ডাকে আমার শৈশব ফিরে আসে
শ্লেট, চকখড়ি আর বাদামি রঙের
ব্যাগ হাতে। গলিতে আবছা কণ্ঠস্বর। আরো কিছু
প্রিয় স্মৃতি-আলোড়ণকারী শব্দ শোনার আশায়
ইচ্ছে হয় কান পেতে থাকি।
কেউ এসে ছোঁবে ব’লে
গোলাপ প্রতীক্ষা করে টবে, ফুলদানি
ডাকে তাকে সামাজিক আঙ্গিকে অথচ
সে কেবলি দারুণ অসামাজিক কারো
হাতে যেতে চায়,
মেঘের হৃদয় ফুঁড়ে কনে-দেখা-আলোয় চকিতে
উদ্ভাসিত কারো মুখ। কবে
দেখা হয়েছিলো তার সঙ্গে? মনে আছে
দুপুরকে ম্লান ক’রে তার ব’সে-থাকা বিকেলের বারান্দায়
দাঁড়ানো নিভৃত ছন্দে, সেই মুখ দেখছি এখন
স্মৃতি নাকি মেঘের কৃপায়!
ইচ্ছে হয়, সেদিকে তাকিয়ে থাকি বেশ কিছুকাল।
ছোটছুটি চলছেই, এক বিন্দু থেকে
আরেক বিন্দুতে নিত্য চরকির মতো
ঘোরা ফেরা। এরই মধ্যে দ্রুত
আকাশে তাকানো, বকুলের ঘ্রাণ নেয়া আর কাউকে সী-অফ
করতে এসে ইস্টিশানে কেমন অস্থির
পায়চারি করা। ট্রেন ইস্টিশান ছেড়ে
যাবার পরেও
কোলাহল-কমে-আসা প্ল্যাটফর্মে ইচ্ছে হয় একটু দাঁড়াই।
এই যে আমি এলাম
এই যে আমি এলাম, এর কোনো তাৎপর্য কি
হীরের মতো
জ্বল জ্বল করবে আজকের অমাবস্যায়?
ক্রোশ ক্রোশ পথ পাড়ি দিয়ে,
সত্তায় নিয়ে অনেক গ্রীষ্ম আর শীতের নখচিহ্ন
এসেছি তোমার ঘরে এবং
আমার প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই সারা ঘরে
ধুলো আর লতাগুল্মের গন্ধ,
নদীর তোলপাড়,
অজস্র পাখির ডানার ঝাপ্ট
আর অপরাহ্নের নিস্তেজ আলোর ঝিকিমিকি।
ভালো করে তাকাও আমার দিকে।
তোমার চোখ আমার অস্তিত্বে চুমো খেলে
আমার যৌবনের দিনগুলি
গুণীর তানের মতো বেজে উঠবে নিমেষে
আমার বুকের ভেতর,
দুলে উঠবে এক হাজার এক রাত্রির
অতুলনীয় ঝাড়লন্ঠন।
এখন আমি বসবো নাকি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকবো-
মনস্থির করতে পারছিনা।
মুহূর্তগুলি আমার হৃৎপন্ডকে খুঁচিয়ে
রক্তাক্ত করছে, যেমন
একজন কাঁকড়ার মুখিয়ে-থাকা দাঁড়া ক্রমাগত
খোঁচায় আমার কবিতাকে।
এবং আমার মাথায় এখন শৈশবের
হংসযুগলের মৃত্যু, একজন উন্মাদের বাদামি দাড়ি,
অবনীন্দ্রনাথের কাটুম কুটুম,
হরিণের চিত্রল যৌবন, বাৎসায়নের কামসূত্র,
বুদ্ধের উপবাসী মুর্তি, আমার
মরহুম পিতার ফটোগ্রাফ, রসেটির সনেট,
মদেলিয়ানীর শায়িত মহিলা,
রাশিয়ার নাছোড় তুষারে আটকে-পড়া
নাৎসী বাহিনী আর অ্যানি ফ্রাঙ্কের ডায়েরি
কেবল তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।
আমরা দুউ’জন দু’টি শরীরের ভিন্নতা
অতিক্রম করতে চাইছি
চুম্বনে, আলিঙ্গনে, উথালপাতাল সঙ্গমে।
অথচ কিছুতেই আমি
তোমার প্রকৃত নাগাল পাচ্ছি না।
তাহলে কি ব্যর্থ আমার এই আসা?
আমার প্রশ্নকে স্তব্ধতায় মুড়ে রেখে তুমি
হাই তুললে, সুইচ অন করে দিলে ক্যাসেট প্লেয়ারের।
ভরাট গলার গায়কের কণ্ঠস্বরকে
ধারণ করল তোমার ঘর, সিগারেটের ধোঁয়া
পেঁচিয়ে উঠলো স্মৃতির মতো, জটিল চিন্তার মতো।
দু’পা এগিয়ে গেলাম ঘরের বাইরে,
বিদায়ের প্রতি উদাসীন তুমি আরো বেশী
স্তব্ধতার সরোবরে ডুবসাঁতার কাটলে-
অথচ তুমিই আমাকে ডেকেছিলে।
একটি গল্প
একটি তরুণ
একটি তরুণী
একটি শ্যামল পার্ক
একটি পুরুষ
একটি নারী
একটি নিভৃত ঘর
একটি পুরুষ
একজন নারী
একটি দোলনা
দোলনায় তুলোর মতন
তুলতুলে শিশু
একটি পুরুষ
একজন নারী
যুগল কবর
একটি বালক
একটি বালিকা
একটা সবুজ মাঠ মাঠে লাল বল
একটি তরুণ
একটি তরুণী
একটি শামল পার্ক।