- বইয়ের নামঃ আমার কোন তাড়া নেই
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- প্রকাশনাঃ জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
আজকাল খুব বেলা করে
আজকাল খুব বেলা করে ঘুম ভাঙে আমার
অথচ এমন একদিন ছিল
যখন আমি অন্ধকার থাকতেই জেগে উঠতাম
শুনতে পেতাম অনেক দূর থেকে কোনো পাখির গান
অনেকক্ষণ ধরে বালিশে মুখ গুঁজে
পাখির চাউনি স্বপ্নে দেখা ঘোড়ার চমকিলা পিঠ আর
একটি মেয়ের সোমত্থ বুকের কথা ভাবতাম
দমকা হাওয়ায় উলটে যাওয়া নীল পদার আড়ালে
জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে একটি কি দুটি তারা চোখে পড়ত
আজকাল বেশ বেলা করে ঘুম ভাঙে আমার
ঘুম ভাঙার পরও
বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করে না
দাড়ি কামাতে ভাল লাগে না
এক সময় খুব সিগারেট খেতাম প্যাকেটের পর প্যাকেট
এখন সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি
কিসসু আমার ভাল লাগে না
সকালবেলা মানে ন’টা-দশটার পর থেকেই
আমার মন খারাপ থাকে
আস্ত সকালবেলাটাকেই চুসকি মনে হয় বিছানার
চটকানো চাদরটার দিকে তাকাই
গিজগিজে দাড়িতে হাত বুলোই বাকরখানির ঘ্রাণ
ভেসে আসে কোত্থেকে রেডিওতে গান বাজে হাসন রাজার
একটা মেষপালক আর একটা গয়লানী জবর
জোড় খায় ঝোঁপেঝাড়ে কবে যেন কোন তৈলচিত্রে
দেখেছিলাম মনে পড়ে
চাটা বিস্বাদ লাগছে দাঁত দিয়ে রুটি ছিঁড়ি
খেতে হবে বলেই খাওয়া অনেক আগে
একজন বুড়োসুড়ো খুব ফর্সা মানুষ যার নাক ছিল
ঈগলের চঞ্চুর মতো
চায়ের বাটির দেয়ালে লেগে থাকা চায়ের
ভেজা পাতার দিকে চোখ রেখে আমাকে
বলেছিলেন তোমার জীবন যাবে বুঝেছ হে ছোকরা
কালি ছিটোতে ছিটোতে
তা কালি নেহাৎ কম ছিটোইনি রবীন্দ্রনাথের মুখ
কাজী নজরুল ইসলামের মুখ
জীবনানন্দের মুখ বুদ্ধদেব বসুর মুখ
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখ
কমলকুমার মজুমদারের মুখ একরাশ ফুল হয়ে ভাসে
আমার চেতনা প্রবাহে
ইদানীং সকালবেলা থেকেই মন খারাপ থাকে আমার
দাড়ি কামাতে ভাল লাগে না
মাথায় চিরুনি চালাতে ভাল লাগে না
সেলুনে যেতে ভাল লাগে না
অফিসে যেতে ভাল লাগে না
পরস্ত্রীর সঙ্গে দিল্লাগি ভাল লাগে না
টাইপরাইটারের আওয়াজ শুনতে ভাল লাগে না
পিকাসোর জীবনী পড়তে ভাল লাগে না
বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা দিতে ভাল লাগে না
স্ত্রীকে চুমু খেতে ভাল লাগে না
সাদা কাগজ দেখতে ভাল লাগে না
খবরের কাগজের হেডলাইনে
চোখ বুলোতে ভাল লাগে না
মায় কালি ছিটোতে ভাল লাগে না
এখন আমি সিগারেট খাই না
আবার ধরব কিনা ভাবছি
আমার রক্তের ভেতরে গোধূলি একটা স্তোত্র তৈরি করছে
আমার মগজের ভেতরে
এক ঝাঁক পাখি খড়কুটো জড়ো করছে দিনরাত
আমার বুকের ভেতরে ক্রমাগত
একটা রুপোলি গাছ থেকে পাতা ঝরে পড়ছে
এবং জীবন
কুষ্ঠরোগীর ফোলা ঠোঁট নিয়ে চুমো খাছে আমাকে
মাঝে মাঝে মনে হয় নিজেকে
ফাঁসিতে লটকে দিই কিংবা নিজেই এই মাথাটা
পেতে দিই চলন্ত ট্রেনের চাকার নিচে
কিংবা সূর্যাস্তের রঙের মতো অনেকগুলো ট্যাচলেট খেয়ে
অসম্ভব লম্বা একটা ঘুম দিই
কিন্তু হঠাৎ মনে পড়ে যায় একজন বলেছিলেন
তোমার জীবন যাবে কালি ছিটোতে ছিটোতে
দেখি কালি আমাকে শেষ পর্যন্ত
কতটা ডোবাতে পারে কতটা।
আমার অসুখ
হ্যালো হ্যালো জাভেদ, তুমি
শুনতে পাচ্ছ?
এখানে কিছুই শোনা যাচ্ছে না।
অনেক্ষণ ধরে চেষ্টা করছি, শুধু হ্যালো হ্যালো
বলাই সার, ওপার থেকে
কোনো সাড়াশব্দ নেই। টেলিফোনের ভেতর
একটা ভূতুড়ে আওয়াজ ছাড়া
অন্য কোনো ধ্বনি আমার কানে
বাজছে না আজ।
অথচ একজন মানুষের কণ্ঠস্বর
শোনার জন্যে আমি কী রকম তৃষ্ণার্তা হয়ে উঠেছি
তুমি তা বুঝতে পারবে না জাভেদ।
ক’দিন ধরে আমি এই আমার একলা ঘরে
বিছানাবন্দি হয়ে আছি। আমার টিপয়ে এখন
সূর্যাস্তের রঙের মতো
ত্র্যান্টিবায়টিক ক্যাপসুল, ভিটামিন বি কমপ্লেক্স,
থার্মেমিটার আর একটা পিরিচে
কয়েকটা বিস্কুট। বুঝতেই পারছ জাভেদ
এই ঘর থেকে বের হবার সামর্থ্য আমার নেই।
আজ কদিন ধরে আমি কোথাও
যেতে পারছি না। মাঝে মাঝে দেয়ালের টিকটিকির শব্দ
পাখিটাখির গান কিংবা কোনো উঠাইগিরা
কুকুরের ডাক শুনতে পাই। কিন্তু জাভেদ
এখন আমি সবচেয়ে বেশি শুনতে চাই
একজন মানুষের প্রকৃত কণ্ঠস্বর।
আমি সেই থেকে একটানা হ্যালো হ্যালো করে
ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, কিন্তু তুমি
এখনো নিরুত্তর। কতদিন আমি তোমার ভরাট গলার
ওঠানামা শুনি না।
হাসপাতালের বেড়ে নয়, আমি আমার
নিজের ঘরেই বিছানায় নিঃসঙ্গ শুয়ে আছি।
আমার শিয়রে অনিদ্রোয় হ্রদে ভেসে বেড়ানো
কোনো নার্স নেই গলায় মালার মতো স্টোথিসকোপ দুলিয়ে
ডাক্তার আমার পালসবিট গুনছে না।
শরীরে নিদ্রার রজনীগন্ধা ফোটে না, জাভেদ। কারো
কণ্ঠস্বর, হোক সেই স্বর চেনা কি অচেনা, মধুর
অথবা কর্কশ, শুনতে পেলেই
আমি অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠব।
জাভেদ, অসুখ তো একলা পথে ভ্রমণেই মতো। এখন
আমি ভ্রমণ করছি এক বিশাল
মরুভূমিতে, যেখানে মরীচিকা আছে
মরূদ্যান নেই, সাপে ওগরানো বিষ আছে, নেই
এক ফোঁটা দ্রাক্ষারস। আমি এই মরুভূমির
বালিয়াড়িতে মুখ থুবড়ে পড়ছি
বারংবার, রাশি রাশি বালুকণায় ভরে গিয়েছে
আমার মুখ, আমার কণ্ঠনালী। এখন আমি
প্রাণপণে চাই প্রত্যাবর্তন।
আমি চেয়ে আছি অস্পষ্ট দিগন্তের দিকে,
যেমন তীর্থযাত্রী আপন নিবাসে
ফিরে আসার তাগিদে তাকায় তার ফেরার পথে।
জাভেদ, বারবার দিনদুপুরে
রাতবিরেতে বেজে ওঠে আমার টেলিফোন। আর
রিসিভার তুললেই অনেক্ষণ ধরে
একটা যান্ত্রিক ভূতুড়ে আওয়াজ হতে থাকে,
কোনো মানুষের কণ্ঠস্বর শুনতে পাই না।