- বইয়ের নামঃ পরশুরামের গল্প
- লেখকের নামঃ রাজশেখর বসু
- প্রকাশনাঃ তিতপাবন পাবলিশার
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
অক্রুরসংবাদ
অক্রুরসংবাদ
নমস্কার মশাই। আপনার পাশে একটু বসবার জায়গা হবে? ঢাকুরে লেকের ধারে একটা বেঞ্চে একলা বসে আছি। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে দেখে ওঠবার উপক্রম করছি এমন সময় আগন্তুক ভদ্রলোকটি উক্ত প্রশ্ন করলেন। আমি উত্তর দিলুম, নিশ্চয় নিশ্চয়, বসবেন বই কি, ঢের জায়গা রয়েছে।
লোকটির বয়স পঞ্চাশ—পঞ্চান্ন, লম্বা রোগা ফরসা, মাথায় কাঁচা—পাকা চুল, সযত্নে সিঁথিকাটা, মওলানা আবুল কালাম আজাদের মতন গোঁফ—দাড়ি। পরনে মিহি ধুতি, গরদের পাঞ্জাবি আর উড়ুনি, হাতে রুপো—বাঁধানো লাঠি। দেখলেই মনে হয় সেকেলে শৌখিন বড়লোক। পকেট থেকে একটা বড় কাগজ বার করে বেঞ্চের এক পাশে বিছিয়ে তার ওপর বসে পড়ে বললেন, আমি হচ্ছি অক্রুর নন্দী। মশায়ের নামটি জানতে পারি কি?
আমি বললুম, নিশ্চয় পারেন, আমার নাম সুশীলচন্দ্র চন্দ্র।
—আপনার কি বাড়ি ফেরবার তাড়া আছে? না থাকে তো খানিকক্ষণ বসুন না, আলাপ করা যাক। দেখুন, আমি হচ্ছি একটু খাপছাড়া ধরনের, লোকের সঙ্গে সহজে মিশতে পারি না, যার তার সঙ্গে বনেও না।
আমি হেসে প্রশ্ন করলুম, তবে আমার সঙ্গে আলাপ করতে চাচ্ছেন কেন? যদি না বনে?
অক্রুর নন্দী ভ্রূ কুঁচকে আমার দিকে চেয়ে বললেন, আমি চেহারা দেখে মানুষ চিনতে পারি। আপনার বয়স চল্লিশের নীচে, কি বলেন?
—আজ্ঞে হাঁ।
—তা হলে বনবে। বুড়োদের সঙ্গে আমার মোটেই বনে না, তাদের হাড় চামড়া মন সব শুকিয়ে শক্ত হয়ে গেছে। ভাবছেন লোকটা বলে কি, নিজেও তো বুড়ো। বয়স হয়েছে বটে, কিন্তু আমার মন শুকিয়ে যায় নি।
—অর্থাৎ আপনি এখনও তরুণ আছেন।
অক্রুরবাবু মাথা নেড়ে বললেন, তরুণ ফরুন নই। আমি হচ্ছি একজন বোদ্ধা অর্থাৎ ফিলসফার, জগৎটাকে হ্যাংলা বোকার মতন গবগব করে গিলতে চাই না, চেখে চেখে চিবিয়ে চিবিয়ে ভোগ করতে চাই। চলুন না আমার বাড়ি, খুব কাছেই। রাত্রের খাবারটা আমার সঙ্গেই খাবেন, আমার জীবনদর্শনও আপনাকে বুঝিয়ে দেব।
ভদ্রলোকের মাথায় একটু গোল আছে তাতে সন্দেহ নেই। বললুম, আজ তো বাড়িতে বলে আসি নি, ফিরতে দেরি হলে সবাই ভাববে যে।
—বেশ কাল এই সময়ে এখানে আসবেন, আমি আপনাকে আমার বাড়ি নিয়ে যাব, সেখানেই আহার করবেন। ভাবছেন লোকটা আবুহোসেন নাকি? কতকটা তাই বটে! একা একা থাকি, কথা কইবার উপযুক্ত মানুষ খুঁজে বেড়াই, কিন্তু লাখে একজনও মেলে না। আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনিও একজন বোদ্ধা। কি করা হয়?
—কলেজে ফিলসফি পড়াই।
—বাহা বাহা! তবেই দেখুন আমি কি রকম মানুষ চিনতে পারি।
সবিনয়ে বললুম, যা ভাবছেন তা নই, আমার বিদ্যা বুদ্ধি অতি সামান্য। পুরুত যেমন করে যজমানদের মন্ত্র পড়ায় আমিও তেমনি করে ছাত্রদের পড়াই। নিজেও কিছু বুঝি না, তারাও কিছু বোঝে না।
—ও কথা বলে আমাকে ভোলাতে পারবেন না। আচ্ছা, এখন আলোচনা থাক, আপনি বোধ হয় ওঠবার জন্য ব্যস্ত হয়েছেন, আপনাকে আর আটকে রাখব না। কাল ঠিক আসবেন তো?
অক্রুর নন্দী বাতিকগ্রস্ত বটে, কিন্তু শেক্সপীয়ার যেমন বলেছেন—এঁর পাগলামিতে শৃঙ্খলা আছে। লোকটিকে ভাল করে জানবার জন্য খুব কৌতূহল হল। বললুম, আজ্ঞে হাঁ, ঠিক আসব।
পরদিন যথাকালে উপস্থিত হয়ে দেখলুম অক্রুরবাবু বেঞ্চে বসে আছেন। আমাকে দেখে উৎফুল্ল হয়ে বললেন, আসুন আসুন সুশীলবাবু। এখানে সময় নষ্ট করে কি হবে, আমার বাড়ি চলুন। খুব কাছেই, এই সাদার্ন অ্যাভিনিউ—এর পাশ থেকে বেরিয়েছে হর্ষবর্ধন রোড, তারই দশ নম্বর হচ্ছে আমার বাড়ি।
যেতে যেতে আমি বললুম, যদি কিছু মনে না করেন তো জিজ্ঞাসা করি—মশায়ের কি করা হয়?
অক্রুরবাবু প্রতিপ্রশ্ন করলেন, আপনি আত্মা মানেন?
—বড় কঠিন প্রশ্ন। আমার একটা আত্মা জন্মাবধি আছে বটে, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বদলেও যাচ্ছে, কিন্তু জন্মের আগেও সেই আত্মাটা ছিল কিনা তা তো জানি না।
—ও, আপনি হচ্ছেন আত্মাবাদী অ্যাগনস্টিক। আপনার বিশ্বাস আপনার থাকুক, তাতে আমার কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু আমি জন্মান্তরীণ আত্মা মানি। আমার গত জন্মের আত্মাটি খুব চালাক ছিল মশাই, বেছে—বেছে বড়লোকের বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেছে।
—আপনি ভাগ্যবান লোক।
—তা বলতে পারেন। বাবা এত টাকা রেখে গেছেন যে, রোজগারের কোনও দরকারই নেই। অন্নচিন্তা থাকলে উচ্চচিন্তা করতে পারতুম না। আমি বেকার অলস লোক নই, দিনরাত গবেষণা করি কিসে মানুষের বুদ্ধি বাড়বে, সমাজের সংস্কার হবে। কিন্তু মুশকিল কি জানেন? আমি অন্তত দুশ বৎসর আগে জন্মেছি, এখনকার লোকে আমার থিওরি বুঝতেই পারে না।
—আমিই যে বুঝব সে ভরসা করছেন কেন?
—বুঝবেন, একটু চেষ্টা করলেই বুঝবেন। আপনার দুই কানের ওপরে একটু ঢিপি মতন আছে, ওই হল বোদ্ধার লক্ষণ। আসুন, এই আমার আস্তানা অক্রুরধাম। পৈতৃক বাড়িটি কাকারা পেয়েছেন, এ বাড়ি আমি করেছি।
অক্রুরধাম বিশেষ বড় নয় কিন্তু গড়ন ভাল। বারান্দায় চার—পাঁচ জন দারোয়ান চাকর ইত্যাদি একটা বেঞ্চে বসে গল্প করছিল, মনিবকে দেখে সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়াল। অক্রুরবাবু হাতের ইশারায় তাদের বসতে বলে আমাকে তাঁর বৈঠকখানা ঘরে নিয়ে গেলেন। ঘরটি মাঝারি, আসবাব অল্প, কিন্তু খুব পরিচ্ছন্ন।