- বইয়ের নামঃ মধ্যাহ্ন
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ অন্যপ্রকাশ
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী, ইতিহাস
সময় ১৯০৫
উৎসর্গ
মেহের আফরোজ শাওন
পরম করুণাময় ত্ৰিভুবনের শ্রেষ্ঠ উপহার তাকে দিয়েছেন। তার কোলভর্তি নিষাদ নামের কোমল জোছনা। আমার মতো অভাজন তাকে কী দিতে পারে? আমি দিলাম। মধ্যাহ্ন। তার কোলে জোছনা, মাথার উপর মধ্যাহ্ন। খারাপ কী?
ভূমিকা
আমার সর্বকনিষ্ঠ ভ্রাতা তার নিজের লেখালেখির একটা নাম দিয়েছে- ‘আবজাব’। সে যা-ই লেখে তা-ই নাকি আবজাব! আমি আমার লেখার আলাদা কোনো নাম দিতে পারলে খুশি হতাম। যেমন খুশি সাজো’র মতো যেমন খুশি লেখা। আমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা সে-রকমই। আমি লিখি নিজের খুশিতে। আমার লেখায় সমাজ, রাজনীতি, কাল, মহান বোধ (!) এইসব অতি প্রয়োজনীয় (?) বিষয়গুলি এসেছে কি আসে নি তা নিয়ে কখনো মাথা ঘামাই নি। ইদানীং মনে হয়— আমার কোনো সমস্যা হয়েছে। হয়তোবা ব্রেনের কোথাও শর্ট সার্কিট হয়েছে। যে-কোনো লেখায় হাত দিলেই মনে হয়- চেষ্টা করে দেখি সময়টাকে ধরা যায় কি-না। মধ্যাহেও একই ব্যাপার হয়েছে। ১৯০৫ সনে কাহিনী শুরু করে এগুতে চেষ্টা করেছি। পাঠকরা চমকে উঠবেন না। আমি ইতিহাসের বই লিখছি না। গল্পকার হিসেবে গল্পই বলছি। তারপরেও…
হুমায়ূন আহমেদ
নুহাশপল্লী, গাজীপুর
০১.
হরিচরণ সাহা তার পাকাবাড়ির পেছনে পুকুরঘাটে বসে আছেন।
তাঁর বয়স পঞ্চাশ। শরীর শক্ত। গড়পড়তা মানুষের তুলনায় বেশ লম্বা বলেই হাঁটার সময় কিংবা বসে থাকার সময় ঝুকে বসেন। তাঁকে তখন ধনুকের মতো দেখায়। তার মাথাভর্তি ধবধবে শাদা চুল। হঠাৎ হঠাৎ তিনি চুলে কলপ দেন, তখন তাকে যুবাপুরুষের মতো দেখায়। তার পরনে শান্তিপুরী ধুতি। গরমের কারণে ধুতি লুঙ্গির মতো পরেছেন। খালি গা। তাঁর গাত্ৰবৰ্ণ শ্যামলা। আজ কোনো এক বিচিত্র কারণে তাকে ফর্সা দেখাচ্ছে।
সকাল দশটার মতো বাজে। এই সময়ে হরিচরণ সোহাগগঞ্জ বাজারে তার পাটের আড়তে বসেন। বাজারে তার তিনটা ঘর আছে। পাটের আড়াতের ঘর। তুলনামূলকভাবে ছোট। এই ঘরের গদিতে বসতেই তাঁর ভালো লাগে। এখান থেকে নদীর একটা অংশ দেখা যায়। নদীর নাম বড়গাঙ। বর্ষায় এই নদী কানায় কানায় পূর্ণ থাকে। বড় বড় লঞ্চ নিয়মিত আনাগোনা করে। তারা কারণে অকারণে ‘ভো’ বাজায়। সেই শব্দ শুনতেও তার ভালো লাগে। আজ বাজারে যাচ্ছেন না, কারণ তার মন সামান্য বিক্ষিপ্ত। পুকুরঘাটে কিছুক্ষণ বসে থাকলে মন শান্ত হবে- এই আশায় তিনি বসে আছেন। ঘাট বাধানো। তিনি নিজেই গৌরীপুর থেকে কারিগর। এনে ঘাট বাঁধিয়েছেন। কারিগরের কাজ তাঁর পছন্দ হয়েছে। ঘাটের ধাপ সে যথেষ্ট পরিমাণে চওড়া করেছে। ভদ্রমাসের গরমে অতিষ্ঠ হলে তিনি এই ঘাটে এসে শুয়ে থাকেন। ঠাণ্ডা পাথরের স্পর্শ বড় ভালো লাগে। পাথরের গা থেকে এক ধরনের গন্ধ এসে তার নাকে লাগে। পাথরের কোনো গন্ধ থাকে না, কিন্তু এই গন্ধ কীভাবে আসে? বিষয়টা নিয়ে তিনি মাঝে মাঝে চিন্তাও করেন।
এখন আষাঢ় মাসের শুরু। গতরাতে বিরামহীন বৃষ্টি পড়েছে বলে আজ আবহাওয়া শীতল। আষাঢ় মাসের কড়া রোদ অবশ্যি আছে। সেই রোদ তাকে স্পর্শ করছে না। ঘাটের সঙ্গে লাগোয়া বাদাম গাছ তাকে ছায়া দিয়ে আছে। এই গাছের পাতা কাঠগোলাপের পাতার মতো ছায়াদায়িনী।
হরিচরণের মনের বিক্ষিপ্ত ভাব কমল না, বরং বাড়ল। এই সঙ্গে তার সামান্য শ্বাসকষ্ট শুরু হলো। শ্বাসকষ্টের উপসর্গ কিছুদিন হলো শুরু হয়েছে। মন-মেজাজ ঠিক না থাকলেই শ্বাসকষ্ট হয়। ঘুমের অসুবিধা হলে শ্বাসকষ্ট হয়। কালরাতে তাঁর ঘুমের কোনো অসুবিধা হয় নি। সারারাত টিনের চালে বৃষ্টি পড়েছে। শীত শীত ভাব ছিল। তিনি পাতলা সুজনি দিয়ে নিজেকে ঢেকে রেখে সুখনিদ্রায় গেছেন। তবে ঘুমের কোনো এক পর্যায়ে অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখেছেন। স্বপ্নটাই তার মন বিক্ষিপ্ত হবার একমাত্র কারণ।
স্বপ্নে তিনি চার-পাঁচ বছর বয়সি একটি শিশুকে কোলে নিয়ে ঘুরছেন। শিশুর মাথায় সোনার মুকুট। তার গাত্রবর্ণ ঘন নীল। স্বপ্নে তার কাছে মনে হলো, শিশুটি তারই সন্তান। আবার এও মনে হলো, এই শিশু শ্ৰীকৃষ্ণ। তাঁর নিজের সন্তান শ্ৰীকৃষ্ণ হতে পারে না— স্বপ্নে এটা মনে হলো না। কোলের শিশুটি একসময় বলল, ব্যথা। তিনি বললেন, কোথায় ব্যথা? সে তার হাত দেখাল। হাতটা কনুইয়ের কাছে কাটা, সেখান থেকে চুইয়ে চুইয়ে রক্ত পড়ছে। রক্তের রঙও নীল। তিনি রক্ত বন্ধ করার জন্যে খুবই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তখন ঘুম ভাঙল। তাঁর বিস্ময়ের সীমা রইল না। হরিচরণের কোনো ছেলেমেয়ে নেই। প্রথম যৌবনে একটা মেয়ে হয়েছিল। তিন বছর বয়সে মেয়েটা দিঘিতে ড়ুবে মারা যায়। পুরোহিতের কী এক বিধানে মেয়েটাকে দাহ করা হয় নি। মুসলমানদের মতো কবর দেয়া হয়েছে। যেখানে কবর দেয়া হয়েছে সেখানে তিনি একটা শিউলি গাছ লাগিয়েছিলেন। সেই গাছ আজ এক মহীরুহ। এই অঞ্চলে এত বড় শিউলি গাছ আছে বলে তিনি জানেন না। তার মেয়ের নামও ছিল শিউলি। এই গাছ বৎসরের পর বৎসর হলুদ বেঁটার শাদা ফুল ফুটিয়েই যাচ্ছে।
প্রথম সন্তানের মৃত্যুর পর দীর্ঘদিন কোনো সন্তানাদি না হওয়ায় তিনি আরেকটি বিবাহ করেন। সেই ঘরেও কোনো সন্তান হয় নি। হরিচরণের দুই স্ত্রীই গত হয়েছেন। তাঁর বিশাল পাকাবাড়ি এখন শূন্য। পাকাবাড়িতে তিনি এখন বাসও করেন না। পাকাবাড়ির দক্ষিণে টিনের দোচালা বানিয়েছেন। টিনের ঘর রাতে দ্রুত শীতল হয়, ঘুমাতে আরাম। বর্ষায় টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ হয়। সেই শব্দ তার কানে আরাম দেয়।