- বইয়ের নামঃ শিশু ভোলানাথ
- লেখকের নামঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- প্রকাশনাঃ বিশ্বভারতী (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অন্য মা
আমার মা না হয়ে তুমি
আর – কারো মা হলে
ভাবছ তোমায় চিনতেম না ,
যেতেম না ঐ কোলে ?
মজা আরো হত ভারি ,
দুই জায়গায় থাকত বাড়ি ,
আমি থাকতেম এই গাঁয়েতে ,
তুমি পারের গাঁয়ে ।
এইখানেতেই দিনের বেলা
যা – কিছু সব হত খেলা
দিন ফুরোলেই তোমার কাছে
পেরিয়ে যেতেম নায়ে ।
হঠাৎ এসে পিছন দিকে
আমি বলতেম , ‘ বল্ দেখি কে ?’
তুমি ভাবতে , চেনার মতো
চিনি নে তো তবু ।
তখন কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে
আমি বলতেম গলা ধরে —
‘ আমায় তোমার চিনতে হবেই ,
আমি তোমার অবু !’
ঐ পারেতে যখন তুমি
আনতে যেতে জল ,
এই পারেতে তখন ঘাটে
বল্ দেখি কে বল্ ?
কাগজ – গড়া নৌকোটিকে
ভাসিয়ে দিতেম তোমার দিকে ,
যদি গিয়ে পৌঁছোত সে
বুঝতে কি , সে কার ?
সাঁতার আমি শিখিনি যে
নইলে আমি যেতেম নিজে ,
আমার পারের থেকে আমি
যেতেম তোমার পার ।
মায়ের পারে অবুর পারে
থাকত তফাত , কেউ তো কারে
ধরতে গিয়ে পেত নাকো ,
রইত না একসাথে ।
দিনের বেলায় ঘুরে ঘুরে
দেখা – দেখি দূরে দূরে —
সন্ধেবেলায় মিলে যেত
অবুতে আর মাতে ।
কিন্তু হঠাৎ কোনোদিনে
যদি বিপিন মাঝি
পার করতে তোমার পারে
নাই হত মা রাজি ।
ঘরে তোমার প্রদীপ জ্বেলে
ছাতের ‘পরে মাদুর মেলে
বসতে তুমি , পায়ের কাছে
বসত ক্ষান্তবুড়ি ,
উঠত তারা সাত ভায়েতে ,
ডাকত শেয়াল ধানের খেতে ,
উড়ো ছায়ার মতো বাদুড়
কোথায় যেত উড়ি ।
তখন কি মা , দেরি দেখে
ভয় হত না থেকে থেকে
পার হয়ে মা , আসতে হতই
অবু যেথায় আছে ।
তখন কি আর ছাড়া পেতে ?
দিতেম কি আর ফিরে যেতে ?
ধরা পড়ত মায়ের ওপার
অবুর পারের কাছে ।
ইচ্ছামতী
যখন যেমন মনে করি
তাই হতে পাই যদি
আমি তবে একখানি হই
ইচ্ছামতী নদী ।
রইবে আমার দখিন ধারে
সূর্য ওঠার পার ,
বাঁয়ের ধারে সন্ধেবেলায়
নামবে অন্ধকার ।
আমি কইব মনের কথা
দুই পারেরই সাথে ,
আধেক কথা দিনের বেলায় ,
আধেক কথা রাতে ।
যখন ঘুরে ঘুরে বেড়াই
আপন গাঁয়ের ঘাটে
ঠিক তখনি গান গেয়ে যাই
দূরের মাঠে মাঠে ।
গাঁয়ের মানুষ চিনি , যারা
নাইতে আসে জলে ,
গোরু মহিষ নিয়ে যারা
সাঁতরে ওপার চলে ।
দূরের মানুষ যারা তাদের
নতুনতরো বেশ ,
নাম জানি নে , গ্রাম জানি নে
অদ্ভুতের একশেষ ।
জলের উপর ঝলোমলো
টুকরো আলোর রাশি ।
ঢেউয়ে ঢেউয়ে পরীর নাচন ,
হাততালি আর হাসি ।
নিচের তলায় তলিয়ে যেথায়
গেছে ঘাটের ধাপ
সেইখানেতে কারা সবাই
রয়েছে চুপচাপ ।
কোণে কোণে আপন মনে
করছে তারা কী কে ।
আমারই ভয় করবে কেমন
তাকাতে সেই দিকে ।
গাঁয়ের লোকে চিনবে আমার
কেবল একটুখানি ।
বাকি কোথায় হারিয়ে যাবে
আমিই সে কি জানি ?
একধারেতে মাঠে ঘাটে
সবুজ বরন শুধু ,
আর – এক ধারে বালুর চরে
রৌদ্র করে ধূ ধূ ।
দিনের বেলায় যাওয়া আসা ,
রাত্তিরে থম্ থম্ !
ডাঙার পানে চেয়ে চেয়ে
করবে গা ছম্ ছম্ ।
খেলা-ভোলা
তুই কি ভাবিস , দিনরাত্তির
খেলতে আমার মন ?
কক্খনো তা সত্যি না মা —
আমার কথা শোন্ ।
সেদিন ভোরে দেখি উঠে
বৃষ্টিবাদল গেছে ছুটে ,
রোদ উঠেছে ঝিলমিলিয়ে
বাঁশের ডালে ডালে ;
ছুটির দিনে কেমন সুরে
পুজোর সানাই বাজছে দূরে ,
তিনটে শালিখ ঝগড়া করে
রান্নাঘরের চালে —
খেলনাগুলো সামনে মেলি
কী যে খেলি , কী যে খেলি ,
সেই কথাটাই সমস্তখন
ভাবনু আপন মনে ।
লাগল না ঠিক কোনো খেলাই ,
কেটে গেল সারাবেলাই ,
রেলিঙ ধরে রইনু বসে
বারান্দাটার কোণে ।
খেলা – ভোলার দিন মা , আমার
আসে মাঝে মাঝে ।
সেদিন আমার মনের ভিতর
কেমনতরো বাজে ।
শীতের বেলায় দুই পহরে
দূরে কাদের ছাদের ‘পরে
ছোট্ট মেয়ে রোদদুরে দেয়
বেগনি রঙের শাড়ি ।
চেয়ে চেয়ে চুপ করে রই ,
তেপান্তরের পার বুঝি ঐ ,
মনে ভাবি ঐখানেতেই
আছে রাজার বাড়ি ।
থাকত যদি মেঘে – ওড়া
পক্ষিরাজের বাচ্ছা ঘোড়া
তক্খুনি যে যেতেম তারে
লাগাম দিয়ে কষে ।
যেতে যেতে নদীর তীরে
ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমীরে
পথ শুধিয়ে নিতেম আমি
গাছের তলায় বসে ।
এক – এক দিন যে দেখেছি , তুই
বাবার চিঠি হাতে
চুপ করে কী ভাবিস বসে
ঠেস দিয়ে জানলাতে
মনে হয় তোর মুখে চেয়ে
তুই যেন কোন্ দেশের মেয়ে ,
যেন আমার অনেক কালের
অনেক দূরের মা ।
কাছে গিয়ে হাতখানি ছুঁই
হারিয়ে – ফেলা মা যেন তুই ,
মাঠ – পারে কোন্ বটের তলার
বাঁশির সুরের মা ।
খেলার কথা যায় যে ভেসে ,
মনে ভাবি কোন্ কালে সে
কোন্ দেশে তোর বাড়ি ছিল
কোন্ সাগরের কূলে ।
ফিরে যেতে ইচ্ছে করে
অজানা সেই দ্বীপের ঘরে
তোমায় আমায় ভোরবেলাতে
নৌকোতে পাল তুলে ।
ঘুমের তত্ব
জাগার থেকে ঘুমোই , আবার
ঘুমের থেকে জাগি —
অনেক সময় ভাবি মনে
কেন , কিসের লাগি ?
আমাকে , মা , যখন তুমি
ঘুম পাড়িয়ে রাখ
তখন তুমি হারিয়ে গিয়ে
তবু হারাও নাকো ।
রাতে সূর্য , দিনে তারা
পাই নে , হাজার খুঁজি ।
তখন তা’রা ঘুমের সূর্য ,
ঘুমের তারা বুঝি ?
শীতের দিনে কনকচাঁপা
যায় না দেখা গাছে ,
ঘুমের মধ্যে নুকিয়ে থাকে
নেই তবুও আছে ।
রাজকন্যে থাকে , আমার
সিঁড়ির নিচের ঘরে ।
দাদা বলে , ‘ দেখিয়ে দে তো । ‘
বিশ্বাস না করে ।
কিন্তু , মা , তুই জানিস নে কি
আমার সে রাজকন্যে
ঘুমের তলায় তলিয়ে থাকে ,
দেখি নে সেইজন্যে ।