- বইয়ের নামঃ মৃত্যুপুরীর অতিথি
- লেখকের নামঃ ময়ূখ চৌধুরী
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. কাল্পনিক কাহিনি নয়
[কাল্পনিক কাহিনি নয়। সত্য ঘটনা]
মালিক! আমরা চললাম! তোমার ইচ্ছা হলে তুমি আমাদের সঙ্গে আসতে পারো অথবা একলা এখানে থাকতে পারো কিন্তু আমরা আর এগোতে রাজি নই, আমরা ফিরে যাব।
ফ্রাঙ্ক নোভাক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রেড-ইন্ডিয়ানদের দলপতির দিকে তাকাল, তারপর সেই ছোটোখাটো লোকটির উপর থেকে চোখ ফিরিয়ে দলেব বাকি ছয়জন মানুষকে ভালো করে নিরীক্ষণ করলে…
আচ্ছা, এবার আমাদের কাহিনির স্থান, কাল, পাত্রের সঙ্গে পাঠক-পাঠিকাদের পরিচয় করে দিচ্ছি
স্থান-ইকুয়েডরের বনভূমি।
কাল-১৯৫৫ সাল, ডিসেম্বরের কুয়াশা-আচ্ছন্ন প্রভাত। পাত্রদের মধ্যে উপস্থিত আছে কাহিনির নায়ক ফ্রাঙ্ক নোভাক এবং সাতজন কুইচা জাতের রেড-ইন্ডিয়ান মাঝি। কুইচারা এখানে এসেছে নোভাকের সঙ্গে। তারা নোভাকের ভাড়াটে মাঝিও বটে, মোট বহনকারী কুলিও বটে। কিছু অর্থের বিনিময়ে তারা নদীপথে ও বনপথে মালিকের প্রয়োজন অনুযায়ী মাঝি ও কুলির কর্তব্য পালন করতে রাজি হয়েছে। পারিশ্রমিক হিসাবে যে অর্থ তারা দাবি করেছিল তার অঙ্কটা যদিও একটু বেশি তবু ফ্রাঙ্ক নোভাক আপত্তি জানায়নি, হাসি মুখেই কুইচাদের দাবি মেনে নিয়েছিল।
হঠাৎ আজ সকালে কুইচাদের দলপতি মালো বিদ্রোহ ঘোষণা করলে, মালিক! আমরা চললাম। তোমার ইচ্ছা হলে তুমি আমাদের সঙ্গে আসতে পারো অথবা একলা এখানে থাকতে পারো কিন্তু আমরা আর এগোতে রাজি নই, আমরা ফিরে যাব।
একটু থেমে মালো আবার বললে, জিভারোরা আমাদের ফিরে যেতে বলেছে।
ফ্রাঙ্ক নোভাক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সকলের মুখের দিকে চাইল, তারপর পকেট থেক সিগারেট বার করলে। একটা সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করে সে প্যাকেটটা সকলের সামনে এগিয়ে ধরলে।
কিছুক্ষণ পর্যন্ত কেউ কথা কইল না, নিঃশব্দে উড়তে লাগল সিগারেটের ধোঁয়া।
নোভাক ধুমপান করছিল আর চিন্তা করছিল, কি উপায়ে লোকগুলোকে এখন সামলানো যায়। এই ঘন জঙ্গলের মধ্যে তল্পিতল্পা নিয়ে পথ চলা সত্যিই অত্যন্ত কঠিন কাজ।
একটু পরে নোভাক মুখ খুলল, তাহলে জিভারোরা তোমাদের ফিরে যেতে বলেছে?
দলপতি মালো বললে, হ্যাঁ মালিক। যে মানুষের মাথায় ঘিলুর বদলে শুকনো কাঠ আছে, সে ছাড়া আর কেউ জিভারোদের আদেশ অমান্য করতে সাহস পাবে না। কমো সে ডাইস? মালিক, তুমি কি আমাদের সঙ্গে থাকবে?
জিভারোদের আদেশ তুমি কি করে শুনলে, মালো? তারা বোধহয় স্বপ্নে তোমার সঙ্গে দেখা করে আদেশ জানিয়ে গেছে? অথবা একটা ছোটো বাঁদর কিচমিচ করে গাছের উপর থেকে জানিয়ে দিয়েছে জিভারোদের নির্দেশ? এ পর্যন্ত কোনো জিভারোকে আমরা দেখতে পাইনি, তাই তাদের আদেশটা কি করে তোমার কানে পৌঁছে গেল সেটা আমি জানতে চাই।
মানলা একেবারে অশিক্ষিত নয়।
রেড-ইন্ডিয়ানদের কুসংস্কারকে কটাক্ষ করে তার উপর যে বিদ্রূপ বর্ষিত হল সেটা সে তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারলে।
তার ভ্রু কুঞ্চিত হল, কপালে জাগল সারি সারি কুঞ্চনরেখা।
গম্ভীর স্বরে সে বললে, না, স্বপ্ন কিংবা বাঁদরের চিৎকারের মতো বাজে প্রমাণের উপর নির্ভর করে আমি ফিরে যেতে চাই না। আমার প্রমাণের ভিত্তি খুব মজবুত।
তাই নাকি? তা তোমার মজবুত প্রমাণটা কি? একবার শুনি।
যেসব গ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা এসেছি, সেইসব জায়গায় আমাদের চোখে পড়েছে বহু মানুষের মুণ্ডহীন দেহ আর সেই মৃতদেহগুলির কাছে বসে চিৎকার করে কাঁদছিল মেয়েরা। নদীর ধারে বালির উপর বিধেছিল মৃত যোদ্ধাদের বর্শাগুলি। এই সব চিহ্ন দেখেই আমরা বুঝতে পারছি জিভারোরা বেরিয়েছে নরমুণ্ডের সন্ধানে। মালিক, আমাদের মুণ্ডগুলো আমরা ঘাড়ের উপর রাখতে চাই– আমরা ফিরে যাব।
অসহিষ্ণু স্বরে নোভাকে বললে, কি মুশকিল। আমরা এখানে তেলের সন্ধানে এসেছি, জিভারোদের সঙ্গে ঝগড়া করতে আসিনি। আমাদের উপর জিভারোদের রাগের কোনো কারণ থাকতে পারে না। মালো! সত্যি কথাটা বলো তো? চাপ দিয়ে আরও টাকা আদায় করতে চাও এই তো?
-না মালিক! আমরা টাকা চাই না, বাঁচতে চাই
মালো, ক্রুদ্ধস্বরে নোভাক বললে, এতগুলো জোয়ান মরদের দলপতি হয়ে তুমি একটা বুড়ি মেয়েমানুষের মতো কথা কইছ? তোমার দেখাদেখি দলের লোকগুলোও মেয়েমানুষের মতো ভয় পাচ্ছে।
মালোর মুখ কালো হয়ে উঠল, মালিক, তোমার কথাটা ঠিক হল না। আগের দিন তোমার সঙ্গে লড়াইতে আমি হেরে গেছি বটে কিন্তু ভয় পেয়ে আমি পরাজয় স্বীকার করেনি তুমি আমার চাইতে অনেক ভালো যোদ্ধা তাই তুমি জয়লাভ করেছ।
তাই নাকি? তাহলে জেনে রাখো আমার কথা না শুনলে আবার আমি তোমার সঙ্গে লড়তে বাধ্য হব।
নোভাকের চোয়াল দুটো শক্ত হয়ে উঠল। কুইচাদের গায়ে হাত দিতে তার ভালো লাগে না। এই লোকগুলিকে সে সত্যিই পছন্দ করে আর তারাও ভালোবাসে তাদের মালিককে। কিন্তু এখন নোভাক কি করবে? এতদূর এগিয়ে সে ফিরে যেতে রাজি নয়।
সে মালোর দিকে তাকাল।
নিজের দুই কাঁধে ঝকানি দিয়ে মালো বুঝিয়ে দিলে লড়াই করতে তার আপত্তি নেই সে প্রস্তুত।
নোভাক মালোর মাথার দিকে হাত বাড়ালে, চুল ধরে মাথাটাকে নীচের দিকে টেনে নিয়ে সজোরে মুখের উপর হাঁটু তুলে দিতে পারলেই লড়াই ফতে