- বইয়ের নামঃ রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও আসেননি
- লেখকের নামঃ মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন
- প্রকাশনাঃ বাতিঘর প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
০১. নুরে ছফা যারপরনাই বিস্মিত
রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও আসেননি – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন
Rabindranath Ekhane Kokhono Asenni by Mohammad Nazim Uddin
প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০১৯
.
উত্সর্গ :
এ বইটি যাকে উৎসর্গ করার কথা ভেবে রেখেছিলাম তার আকস্মিক মৃত্যু আমাকে একটা উপলব্ধি দিয়ে গেছে : প্রিয়মানুষের জন্য কিছু করতে চাইলে অপেক্ষা না করাই ভালো!
বড়বোনের স্বামী হিসেবে নয়, তিনি ছিলেন আমার অভিভাবক, বড়ভাই এবং অবশ্যই বন্ধু। অসম্ভব ভালো আর নরম মনের মানুষ, অন্য মানুষের প্রতি যার ছিলো অপরিসীম মমতা, সেই সাব্বির আহমেদ নাজমীর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। আমার কাছে আপনার স্মৃতি অম্লানই থাকবে।
.
মুখবন্ধ
শব্দটাই প্রথমে তাকে সম্মোহিত করে ফেললো।
দূর থেকে শত শত নারী-পুরুষের কণ্ঠ ভেসে আসছে বসন্তের বাতাসে, সেই সাথে বয়ে নিয়ে আসছে উদ্যানের নাম-জানা না-জানা অসংখ্য ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণ। দিনের প্রথম আলো ছড়িয়ে পড়েছে সবখানে, ছড়িয়ে দিচ্ছে উদ্যানের ঘাসের উপরে মিষ্টি রোদের প্রলেপ।
নুরে ছফা বুকভরে সেই ঘ্রাণ আর রোদের গন্ধ নিলো। কিন্তু ভেসে আসা সুর তাকে সম্মোহিত করে নিয়ে চললো শব্দটার উৎসের দিকে। ধীরপায়ে এগিয়ে গেলো সে।
গুঞ্জন থেকে সুর। সুর থেকে কথা। শতকণ্ঠের আমন্ত্রণ শুনতে পাচ্ছে এখন।
আয়, আয়, আয়।
সে তোমায় খুঁজে যায়।
তাহার মৃদঙ্গরবে
করতালি দিতে হবে…
ঘোরগ্রস্ত সম্মোহন ভেঙে দৃঢ় পদক্ষেপে, কঠিন সঙ্কল্প নিয়ে আরেকবার চোখ বোলালো চারপাশে। শত শত নারী-পুরুষও সম্মোহিত হয়ে একদিকেই ধাবিত হচ্ছে যেনো। সহস্র কপালে সহ লাল সূর্য! কালো মেঘপুঞ্জে চেপে বসেছে শ্বেতশুভ্র ফুলের মেঘ! সেই ফুলের গন্ধে মৌ মৌ করছে চারপাশ।
সূর্যের তেজ বাড়ছে ধীরে ধীরে, ছফা টের পেলো তার কপাল ঘেমে উঠেছে, সেই ঘেমে ওঠা কপালে হাত রেখে রোদ আড়াল করে দেখতে লাগলো এবার। কিন্তু দৃশ্যের চেয়ে শব্দটাই প্রকট তার কাছে।
এসো এসো হে তৃষ্ণার জল,
কলকল ছলছল
ভেদ করো কঠিনের ক্রূর বক্ষতল
কলকল্ ছলছল্…
তৃষ্ণার্ত ছফা এগিয়ে চললো আরো সামনের দিকে। বেলিফুলের সৌরভ তার আশেপাশে। হাঁটতে হাঁটতেই চারপাশটা দেখে নিলো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে, এমন একটি মুখ খুঁজে বেড়াচ্ছে যেটা তার আধো-ঘোর আর আধো জাগরণের মাঝে দুলছে বিগত তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে।
তুমি যে খেলার সাথি
সে তোমারে চায়।
তাহারি সোনার তান
তোমাতে জাগায় গান…
সামনেই দেখতে পেলো বিশাল বটবৃক্ষের নিচে জড়ো হওয়া মানুষের দল। লাল-সাদার সমারোহ। তবলার বোল। করতালের টুং টাং। হারমোনিয়ামের বিভ্রান্তিকর স্বর! সঙ্গীতের মুর্ঘনা গ্রাস করে নিয়েছে চারপাশ। হাজার হাজার নারী-পুরুষ ঘাসের উপরে বসে কয়েক শ’ নারী-পুরুষের সমবতে কণ্ঠের গান শুনছে।
এসো হে প্রবল
কলকল ছলছল…
বৈশাখের প্রথম দিনে নুরে ছফা আবারো ধন্দে পড়ে গেলো। একে একে দেখতে লাগলো সবাইকে। তার মন বলছে, এই ভীড়ের মধ্যে সে আছে। কিন্তু তার যুক্তিবুদ্ধি তাতে সায় দিচ্ছে না।
বিগত তিন বছর ধরে হন্যে হয়ে খুঁজে যাচ্ছে একটা মুখ। যেখানেই যায়, যখনই সুযোগ পায়, এই একটা মুখই খোঁজে। গতকাল রাতে হুট করে তার মনে পড়ে যায়, পরদিন পহেলা বৈশাখ। ঢাকার বৈশাখ মানেই ছায়ানট। রমনার বটমূল। সুরে সুরে রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণ সঙ্গীত : এসে হে বৈশাখ, এসো এসো!
আমি আসলেই রবীন্দ্রনাথের ভক্ত। সেই ছোটোবেলা থেকে। আমার মা খুব ভালো রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতো..আমাকেও শিখিয়েছিলো। ছায়ানটের প্রথম দিককার ছাত্র ছিলাম আমি…৬২-তে যখন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করা হলো, সেই ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানে অনেকের সঙ্গে আমিও ছিলাম…
কথাগুলো ছফার মস্তিষ্কে অনুরণিত হতে থাকে তখন। তার অন্তরাত্মা বলে ওঠে, সে আসবে! নিদেন পক্ষে, আসার সম্ভাবনা আছে।
গত রাতে উত্তেজনার চোটে ঠিকমতো ঘুমাতেও পারেনি, ভোর হতেই বিছানা ছেড়েছে সে, ছুটে এসেছে এখানে-রমনার এই সবুজ চত্বরে।
নূরে ছফা এমন একটি মুখ খুঁজে বেড়াচ্ছে, যে মুখটি তার নিজের কাছেই ঘোলাটে, অস্পষ্ট। হাজার হাজার মানুষের ভীড়ে সেই মুখটি খুঁজে বের করা রীতিমতো পাগলামি বলেই মনে হচ্ছে এখন।
ঘন্টাখানেক পর কোলাহল থেকে সরে গিয়ে একটা সিগারেট ধরালো সে। মিষ্টি রোদ এখন মাথার তালুতে আঁচ দিচ্ছে, বিদ্ধ করছে দুচোখ। পায়ের নিচে ঘাসগুলো। হাজার হাজার পদভারে পিষ্ট হচ্ছে তারা। সবুজ চত্বরটি এখন লাল-সাদা-নীল-হলুদ রঙে ছেয়ে গেছে। সঙ্গীতের মিষ্টিধ্বণি ছাপিয়ে প্রবল হতে শুরু করেছে মানুষের কোলাহল।
নিজেকে বেমানান লাগছে এখানে। অন্যদের মতো পায়জামা-পাঞ্জাবি নয়, ক্রিমরঙের পোলো শার্ট, গাঢ় নীলের গ্যাবাডিনের প্যান্ট আর পায়ে মোকামিস পরে আছে সে।
সিগারেটে টান দিয়ে আবারো জনসমুদ্রের দিকে তাকালো ছফা। খুঁজে খুঁজে তার চোখ ক্লান্ত। টের পেলো, একটু ঘেমে উঠছে। কিন্তু এখনও হাল ছেড়ে দেবার কথা ভাবছে না।