- বইয়ের নামঃ সাদাসিধে কথা
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ অনন্যা
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
অভিভাবক যখন অভিশাপ
১.
গত কয়েক সপ্তাহে আমার বেশ কিছু মন খারাপ করা অভিজ্ঞতা হয়েছে। একজন মায়ের সঙ্গে দেখা হয়েছে যিনি তার মেয়েকে নিয়ে সবসময়ই এক ধরনের আতঙ্কে থাকেন। আতঙ্কটি উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়, তার কারণ মেয়েটি বেশ কয়েকবার আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছে। মেয়েটির বয়স বেশি নয়, জীবনের নানা ধরনের যে জটিলতা একজনকে আত্মহত্যার মতো ভয়ঙ্কর একটা ব্যাপারের দিকে ঠেলে দেয়, মেয়েটির সেই বয়স হয়নি। মেয়েটি মাত্র স্কুলে পড়ে, এই বয়সে ছেলেমানুষি কল্পনা করেই সময় কেটে যাওয়ার কথা। মেয়েটির বেলায় তা ঘটেনি। কারণ, সে কোন বিষয়ে লেখাপড়া করবে সেটি নিয়ে তার বাবা-মা তার ওপর এমন চাপ দিয়েছেন যে, তার পক্ষে সে চাপ সহ্য করা সম্ভব হয়নি, হঠাৎ করে তার জীবন এলোমেলো হয়ে গেছে। মা এখন মেয়েটিকে নিয়ে এক মানসিক ডাক্তার থেকে আরেক মানসিক ডাক্তারের কাছে ছুটে বেড়াচ্ছেন। অবাক হয়ে আবিষ্কার করছেন, একটা কম বয়সী কিশোরী মেয়ের নিজের ভেতরে দুর্ভেদ্য একটা দেয়াল তুলে রেখেছে, সেই দেয়াল ভেদ করে কেউ এখন ভেতরে প্রবেশ করতে পারে না।
আমি আরেকটি মেয়ের কথা জানি যে তার মায়ের প্রচণ্ড চাপে অতিষ্ঠ হয়ে ঠিক করল সে আর বাড়িতে থাকবে না, তাই একদিন সে বাড়ি থেকে পালিয়ে গেল। এটি একটি ভয়ঙ্কর গল্প হতে পারত, শেষ পর্যন্ত হয়নি। কারণ মেয়েটিকে বহুদূরের একটা এলাকা থেকে সময়মতো উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল। মেয়েটি এখন কেমন আছে আমি জানি না।
মাত্র কয়েকদিন আগে আমার অফিসে একটা ছেলের সঙ্গে দেখা হয়েছে। বাবার পছন্দের ইউনিভার্সিটিতে ছেলেটি ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে ভর্তি হতে পারেনি। তাই বাবা তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন। ছেলেটি এখন আত্মীয়-স্বজন, পরিচিত মানুষের করুণার ওপর নির্ভর করে দিন কাটাচ্ছে, টাকা ধার করে ফরম ফিলাপ করে কোনোভাবে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছে। ছেলেটি আমার কাছে জানতে চেয়েছে, সে এখন কী করবে। আমি বেশ অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম, তাকে বাস্তব এবং কার্যকর কোনো উপদেশ দেওয়ার মতো আমি কিছু খুঁজে পাইনি!
এগুলো হচ্ছে মাত্র গত কয়েক সপ্তাহের উদাহরণ। আমি যদি আরও আগের অভিজ্ঞতার কথা মনে করার চেষ্টা করি, তাহলে এ রকম অসংখ্য ঘটনার কথা বলতে পারব। বাবা-মায়ের নির্দয় ব্যবহারে মানসিকভাবে পুরোপুরি বিপর্যস্ত হয়ে যাওয়ার উদাহরণ যে রকম আছে, ঠিক সে রকম বাড়ি থেকে পালিয়ে নিজের নাম পাল্টে দ্বিতীয়বার এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে একেবারে নতুন করে একা একা নিজের জীবন শুরু করার উদাহরণও আছে।
কেউ যেন মনে না করে, আমি বলার চেষ্টা করছি আমাদের সব মা-বাবাই বুঝি এ রকম। আমি যে উদাহরণগুলো দিয়েছি সেগুলোর সংখ্যা আসলে খুবই কম। কিন্তু তারপরও এ রকম উদাহরণ যে কম হলেও আছে সেটাই আমাদের দুশ্চিন্তার কারণ। দুশ্চিন্তাটুকু একটু বেশি, কারণ যতই দিন যাচ্ছে আমাদের মনে হচ্ছে এ রকম উদাহরণের সংখ্যা বাড়ছে। অনেক বাবা-মা কেন জানি খুব সহজ একটা বিষয় বুঝতে পারেন না, তাদের ছেলেমেয়েরা যত ছোটই হোক, তারা পূর্ণাঙ্গ মানুষ, তাদের নিজেদের বিচার-বুদ্ধি আছে এবং তাদের ওপর নিজেদের কোনো একটা সিদ্ধান্ত জোর করে চাপিয়ে দিলে তার ফল কখনও ভালো হতে পারে না।
কয়েক বছর আগে টেলিভিশনের একটা চ্যানেল আমাকে একটা নিয়মিত অনুষ্ঠানে কিছুদিনের জন্য উপস্থিত হতে রাজি করিয়েছিল। শুক্রবার সকালবেলা আমি কিছুক্ষণের জন্য টেলিভিশনে ‘লাইভ’ বাচ্চাদের সঙ্গে কথা বলতাম। বাচ্চারা আমার কাছে তাদের প্রশ্নগুলো পাঠাত, আমাকে সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে হতো। সে সময় আমি এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে আবিষ্কার করেছিলাম, এ দেশের শিশু-কিশোরের জীবনের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, তারা যে বিষয় নিয়ে লেখাপড়া করতে চায় সেখানে তাদের বাবা-মায়ের হস্তক্ষেপ করার অধিকার আছে কিনা!
আমাকে খুব সাবধানে সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে হতো। আমি তাদেরকে বলতাম, তাদের বাবা-মায়ের বয়স যেহেতু বেশি, তাই তাদের জীবনের অভিজ্ঞতাও বেশি। সেই অভিজ্ঞতার কারণে তারা কিছু কিছু বিষয় জানেন, যেগুলো শিশু-কিশোররা এখনও জানে না। তাই তাদের বাবা-মায়ের যুক্তিগুলো তারা শুনতে পারে। কিন্তু নিজের জীবনটা কীভাবে গড়ে তুলবে সেই সিদ্ধান্ত তাদের নিজেদেরই নিতে হবে। আমি আমার জীবনের সিদ্ধান্ত নিজে নিয়েছি। আমার ছেলেমেয়ের বেলাতেও তারা কী নিয়ে লেখাপড়া করতে চায়, সেই সিদ্ধান্ত তাদের নিতে দিয়েছি। আমি মনে মনে আশা করি, সবারই জীবনে এই স্বাধীনতাটুকু থাকুক।
বাবা-মায়েরা তাদের ছেলেমেয়ের একটা সুন্দর জীবন দেখতে চান। কিন্তু সেই সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখার জন্য তারা কতটুকু বাড়াবাড়ি করবেন, সেটাই হচ্ছে প্রশ্ন।
বাবা-মায়েদের বাড়াবাড়ি কী পর্যায়ে যেতে পারে তার একটা উদাহরণ দিই। আমাদের স্কুল-কলেজে এখন সৃজনশীল পদ্ধতিতে প্রশ্ন হয় (যখনই সৃজনশীল পদ্ধতি নিয়ে কথা হয়, তখন কেউ না কেউ বলে, ‘কিন্তু আপনি কি জানেন, এখন সৃজনশীল প্রশ্নের গাইডবই বের হয়ে গেছে? আগে ছেলেমেয়েরা শুধু নিজের পাঠ্যবই মুখস্থ করত, এখন ছেলেমেয়েদের পাঠ্যবইয়ের সঙ্গে সঙ্গে সৃজনশীল গাইডবইটাও মুখস্থ করতে হচ্ছে।’ আমি তাদের মনে করিয়ে দিই, এই গাইডবই মুখস্থ করে তারা কখনোই কোনো সত্যিকারের পরীক্ষার একটা প্রশ্নেরও উত্তর দিতে পারবে না! সত্যিকারের পরীক্ষায় কখনও কোনো প্রশ্ন এই গাইডবই থেকে আসবে না। ছাত্রছাত্রীরা যদি তাদের পাঠ্যবই, শুধু তাদের পাঠ্যবই আগাগোড়া মন দিয়ে পড়ে, তাহলেই তারা সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে)। যাই হোক যখন প্রথমবার সৃজনশীল পদ্ধতিতে পরীক্ষার প্রশ্ন করার উদ্যোগ নেওয়া হলো, তখন হঠাৎ করে তার বিরুদ্ধে এক ধরনের লেখালেখি শুরু হয়ে গেল। আমরা যারা এই পদ্ধতিটার গুরুত্বটুকু ধরতে পেরেছিলাম, তারাও সবাই মিলে এর পক্ষে কথা বলতে শুধু করলাম। তখন হঠাৎ একটা বিচিত্র বিষয় আবিষ্কার করলাম, ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকরা যেভাবে হোক সৃজনশীল পদ্ধতির প্রশ্নপত্র বন্ধ করার জন্য উঠেপড়ে লেগে গেলেন। ঠিক কী কারণ জানি না, সেটা করার জন্য তারা সবাই মিলে আমাকে ‘সাইজ’ করার একটা প্রক্রিয়া শুরু করে দিলেন। দিন নেই, রাত নেই তারা আমাকে ফোন করেন, আমার সঙ্গে কথা বলেন, দল বেঁধে এখানে-সেখানে দেখা করেন, আমাকে নানা বিষয় বোঝানোর চেষ্টা করেন। তাদের সঙ্গে কথা বলে কিছুদিনের মধ্যে আমি আসল ব্যাপারটি আবিষ্কার করলাম, তাদের যুক্তিটি খুবই চমকপ্রদ। তারা আমাকে বলেন, ‘আমরা আপনার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত, এই পদ্ধতিটি খুবই ভালো। কিন্তু এই বছর আমার ছেলেমেয়েরা পরীক্ষা দিচ্ছে। তারা পরীক্ষা দিয়ে বের হয়ে যাক, তারপর যা খুশি করেন আমাদের কোনো আপত্তি নেই!’