- বইয়ের নামঃ এই গৃহ এই সন্ন্যাস
- লেখকের নামঃ মহাদেব সাহা
- প্রকাশনাঃ খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
আজীবন একই চিঠি
নখরে জ্বালিয়ে রাখি লক্ষ্যের দীপ্র ধনুক
যেন এক শব্দের নিষাদ এই নির্মল নিসর্গে বসে কাঁদি, তবু
সেই নির্মম শব্দাবলী ছিঁড়ে আনতে পারি না বলে
সুতীক্ষ্ণ অনুযোগ হতে অব্যাহতি দিন; এই
শোকের শহরে আমি যার কাছে চাই ফুল, কিছু মনোরম
শোভা, যেসবের বিসতৃত বর্ণনা আমি আপনাকে লিখতে পারি, সে
আমার হাতে শুধু তুলে দেয় দুঃখের বিভিন্ন টিকিট।
আমি চাই প্রত্যহ আপনাকে লিখতে চিঠি, আমি চাই প্রতিদিন
লিখতে এই রক্তের গভীর ইচ্ছে, মর্তান্তিক অনুভবগুলি
আমার সবুজ সুখ, কোমল আনন্দ, নির্জন কান্নার স্বর
একাকী হাঁটতে পথে যেসব দুঃখ দিয়ে ভরে নিই যমজ পকেট
ঢাকার এইসব রঙিন দোকান হতে কিনতে পারিনে আমি
একেকটি সুখের সংসার, কাঠের ঘোড়া, সোনালি
চাবুক, তাই কাঁদি শৈশবের শ্যামল নদীর উপাখ্যান
ভেবে, যে স্বরে কাঁদি আমি সঙ্গিহীন মধ্যরাতে সরকারী গোরস্থানে কিংবা
আমার গোপন ঘরে ফিরে এসে জ্বালাই
দিব্যমোম, শোকের গর্তে শুয়ে কাঁদি, কিংবা যখন
পার্কের বেঞ্চে বসে ফেরেববাজ আড্ডা দিই, ফালতু ফক্কর
মিলে অনেকক্ষণ অযথা হাসি, টিটকিরি দিই, অনগৃল বিদ্রূপের
থুথু ছুঁড়ে উল্লসিত হই, তবু কিছুতেই
পারিনে আমি এইসব সুখদুঃখে আপনাকে লিখতে
চিঠি ; শুনুন জনক, আমি চিরদিন শব্দের কাঙাল।
আজীবন তাই আপনাকে লিখি শুধু একই চিঠি, ভালো
আছি, ইত্যাকার
কুশল সংবাদ অথচ প্রতিদিন ভুগি শিরপীড়া,
বুকে কাশি, অবিরাম জ্বর- আমার রুক্ষ চুলে বিলি কাটে
দুঃস্বপ্নের হাত, এসব খবর কি দৈনন্দিন
লেখা যায়! কী করে লিখবো বলুন, ঘরে একা
দুঃসংবাদে কাঁদবে জননী। আজীবন লিখেছি তাই
একই চিঠি, সেই মিথ্যে মর্মহীন একই চিঠি!
হে জনক, সেই নির্র্মম শব্দ নেই এখানে, যা দিয়ে
বাজাতে পারি কান্নার করুণ কণ্ঠ, নক্ষত্রবীথির সুদূর
নীলিমা হতে আমি
তুলে আনতে পারিনে অমল শব্দের বিভা, অন-রঙ্গ ধ্বনি
আত্মার নিঃসঙ্গ স্বর তাই আমি বোঝাতে পারিনে,
হে জনক, পূজনীয় জনক আমার, ইচ্ছের একটি চিঠি
আজো আমি লিখতে পারিনি।
আমার এ-ভয় অন্যরকম
তোমরা সবাই ভয় পাও এই বাইরে যেতে
দুয়ার খুলে বাইরে যেতে
পথ পেরোতে
গাড়ির ভিড়ে বড়ো রাস্তা পার হতে যেই পা বাড়ালে
ভয় পাও এই আগুন দেখে
বারুদ দেখে
দোজখ দেখে ভীষণ রকম গজব দেখে খোদাতালার
তোমরা সবাই ভয় পাও এই দাঙ্গা দেখে
মড়ক লাগলে মহামারী এমনি কিছুর
ভয় পাও ঠিক রাত-বিরেতে অন্ধকারে
যাকে তাকে দেখলে হঠাৎ
হয় পাও এই সাপের বাঘের
চোর-ডাকাতের দৈত্যদানা জলপুলিশের
অনেক কিছুর ভয় তোমাদের
ভয় তোমাদের বাইরে কেবল চেখের ওপার,
আমার এ-ভয় অন্যরকম
অন্য কিছুর
আমার কিছুর
আমার এ-ভয় বাইরে তো নয়
ঘরের ভিতর নিজের ভিতর
আমার এ-ভয় নিজেকে ভয়
আমার এ-ভয় শোবার ঘরে বাথরুমটির
ঠাণ্ডা জলের টবের ভিতর
দাড়ি কাটার লম্বা ক্ষুরে
চায়ের কাপে কাঁটা-চামচে
আমার এ-ভয় আলমারিতে
বইয়ের তাকে ফুলদানিতে
মুখ দেখবার আয়না খুলে ড্রয়ার খুলে
আমার এ-ভয়
আমার এ-ভয় শত্রুকে নয় প্রিয়ার চোখে
নরম ঠোঁটে
নিজের দুটি করে মাঝে নখের ভিতর
আমার এ-ভয় অন্যরকম অন্যরকম।
কোনো বাস নেয় না আমাকে
আজীবন শুধু হাঁটছি আমি
নারী, তার দেয়া সংসারের
ব্যস্ততা নিয়ে দ্রত দৌড়চ্ছি কেবল
সে আমার ইন্দ্রিয়ে জন্ম দিয়ে গেছে কাজ
ভালোবাসা, প্রলোভন মানবিক ব্যবহার
নারী তার দিয়ে গেছে দুচোখের গুপ্ত ঠিকানা
তার সঙসারের সন্তানের অভিলাষ নিয়ে
তার সে চোখের ইমেজ হাতে
আমি দৌড়চ্ছি কেবল ;
স্টপেজে স্টপেজে যাই হাত তুলি,
ডেকে বলি, শুনুন আমাকে পৌঁছতে হবে, বড়ো তাড়া
দেরি হলে বন্ধ হয়ে যাবে তার নিয়মিত গেট,
বাসভর্তি লোক হাত নাড়ে, রুক্ষ ড্রাইভার
তার করতলে নিষেধের ঝুলানো সাইনবোর্ড
আমাকে নেয় না বাস আবার দৌড়ই
সামনে স্টপেজ ডবল ডেকার থাকে
লোকজন ওঠানামা করে, ছেড়ে যায় বাস
নারী তার গুপ্ত ঠিকানা বুঝি
আমার নাগাল থেকে দূরে ;
শহরে এখন এতো বাস, ছোটো বড়ো গাড়ি
যানবাহনের ভিড়ে চলা দায়
তবু নেই জায়গা কোথাও, সব বাস ভর্তি লোক
স্টপেজ এলেই ড্রাইভার হাত নাড়ে
যেন তার হাত সিনেমা হলের
সামনে হাউসফুল টাঙানো পোস্টার,
যতোই বলি না কেন আমাকে যেতেই হবে
তোমার দূরত্বে যেতে আর কোনো বাস খোলা নেই ;
আমাকে পৌঁছতে হবে নারী আর সংসারের কাছে
আমাকে রেখেই তবু যায় লোকভর্তি বারোটার শেষ বাস,
তোমার দূরত্বে যাবো
কোনো বাস নেয় না আমাকে।
জলসত্র
শহরের চৌদিকে ওরা খুলে দেয় সুবিখ্যাত জলসত্র সব
তবু কানে আসে কলরব
ভীষণ পিপাসা এইখানে, জলচাই
মানুষের পিপাসার জল নাই
মিউনিসিপ্যালিটির এই বড়ো বড়ো ট্যাঙ্কের তলায়
বালি আর কঠিন কাঁকর সব জমে আছে। আমাদের বিশুষ্ক গলায়
একবিন্দু শীতল জলের স্বাদ দিতে পারে এমন প্রকৃত কোনো হ্রদ নেই
কাছে কিংবা যেখনেই
তাকাই কেবল আজ চোখে পড়ে ধোঁয়ার কফিন
সগর আর নদীর জল প্রতিদিন
বাষ্পীয় জাহাজে চড়ে চলে যায় দূরবর্তী চাঁদের শহরে
সেইসব প্রাণশূন্য ঘরে
বসে পৃথিবীর শ্যামল জলের বাজার
থরে থরে গজায় বৃক্ষবাড়ি, লোকালয় এখানে হাজার
মরে পিপাসায়, জল নেই শহরে কোথাও
শহরে কোথাও আজ শান্তি নেই, যদিও অনর্গল শান্তির ডঙ্কা পেটাও
খুলে দাও জলসত্র, তবু হায়
এ শহরে মরে লোক ভয়ে জলশূন্যতায় আর
পিপাসায়।