- বইয়ের নামঃ পঞ্চানন মালাকরের গল্প
- লেখকের নামঃপঞ্চানন মালাকর
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
ভূমিকা – পঞ্চানন মালাকর
দরজা খুলেই অমলের পিছনের মানুষটিকে দেখে পাথর হয়ে গেল রমিতা। একদিন যাকে দেখলে তার মনের মধ্যে সমুদ্রের ঢেউ উছলে পড়ত, সারা শরীরে কুল কুল করে বয়ে যেত এক শিহরণের নদী, সেই অনুতোষ এসেছে তারই কাছে। আর কেন এসেছে তাও রমিতা জানে। কয়েক মুহূর্ত কোনও কথা ফুটল না মুখে। অভ্যাগতদের অভ্যর্থনার কথাও ভুলে গেল যেন। স্থানকাল-পাত্র সবই বিস্মৃত হল। কী করবে ভাবতে পারছে না এই মুহূর্তে। তাকে নিশ্চল পাথর হতে দেখে, অবাক হল অমল। তাড়া দিয়ে বলল, কী হল মিতাদি! আমাদের বসতে বলবে না নাকি?
ও হ্যাঁ! এসো। দরজা থেকে অপ্রস্তুত ভঙ্গিমায় সরে দাঁড়ায় সে, আসুন।
দ্বিতীয় আহ্বান অনুতোষকে লক্ষ্য করে। আপনি সম্বোধন ছুঁড়ে দিয়েই তার মনের মধ্যে একটা হাসি খেলে গেল। যে মানুষটিকে একদিন প্রিয়তম সম্বোধনেই ডাকত, তার সঙ্গে আজ সহবতে সংযত হতে হয়। ওদের বসবার ঘরে বসিয়ে ভিতরে চলে যায় রমিতা। হয় তো এই আচমকা দেখা হওয়ার অপ্রস্তুত ভাবটাকে কাটিয়ে ওঠার জন্য একটা আড়াল খোঁজে। বেশ কয়েক বস্ত্র পরে হলেও অনুতোষ তাকে হঠাৎ করে নাড়া দিল। বেশ ভুলে ছিল সেকথা। এভাবে আবার মুখোমুখি হয়ে একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতির সামনে পড়তে হবে, ভাবেনি কোনও দিন। জীবনের একটা অধ্যায়কে সে মুছে ফেলতে চেয়েছিল। কিন্তু মুছে ফেলতে চাইলেই সবকিছুকে কি মোছা যায়?
তা, প্রায় সাত-আট বছর আগের কথা। রমিতা বাইশ বছরের তরুণী। ঝকঝকে চেহারা। চালচলনে একটা উচ্ছলতা। সে সময়েই প্রথম পরিচয় অনুতোষের সঙ্গে। মফস্বল শহরের ছেলে। কলকাতায় ভাল চাকরি নিয়ে এসেছে। চেহারার মধ্যে একটা। মিষ্টি আকর্ষণ। তারই বন্ধুর দাদার সঙ্গে এসেছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে। তখন রমিতা এম.এ পড়ে। একটা আড়ষ্টতা থাকলেও মানুষটিকে তার ভাল লেগেছিল। কলকাতার মেয়ে, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়া রমিতা সেদিন খুব একটা ভাববার সময় পায়নি। অনুতোষের সঙ্গে আলাপ গাঢ়তর হয়ে গেল কয়েকদিনেই। তারপর অনেক গল্প, অনেক নির্জন অবসর। যৌবনের মুক্ত আনন্দের স্রোতে গড়ে নিয়েছিল এক স্বপ্নময় জগৎ। এভাবেই অনুতোষ তার জীবনের রঙ্গমঞ্চের নায়ক হয়ে গেল।
রমিতার মা ছাড়া সংসারে কেউই ছিল না। মা-ই নিজের রোজগারে তাকে মানুষ করছিলেন। একমাত্র মেয়ের সুখের ভাবনাই তার জীবনের লক্ষ্য। প্রথমে অনুতোষের সঙ্গে তার বিয়ের কথায় তিনি আপত্তি করেছিলেন। কিন্তু মেয়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কঠিন হতে পারেননি। অনুতোষের সঙ্গে রমিতার বিয়ে হয়ে গেল। এর কিছুদিন পরেই অনুতোষ কলকাতা থেকে বদলি হয়ে চলে গেল নিজের শহরে।
কলকাতা ছেড়ে যেতে তার খুব কষ্ট হয়েছিল। বিশেষ করে মাকে ছেড়ে যেতেতো মনের মধ্যে কষ্টের ঝড় উঠেছিল। তবুও সে অনুতোষের হাত ধরে গিয়ে উঠেছিল তাদের বাড়িতে।
সেই ওঠাই হল। জীবনের যে মধুর স্বপ্ন মনের আকাশকে রাঙিয়ে তুলেছিল, তার রঙ ফিকে হয়ে হারিয়ে গিয়েছিল অচিরেই। ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত মেয়ের সঙ্গে অনুতোষের পরিবারের মানুষরা কেউ মানিয়ে নিতে পারেনি। বিশেষ করে তার মা। আজ ভাবতেও অবাক লাগে। শিক্ষিত বউ ঘরে এনেছে বলে অনুতোষ তার মায়ের কাছে কম কথা শোনেনি। প্রথম প্রথম মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করত রমিতা। তবুও শেষ রক্ষা করতে পারল না। তাকে নিয়ে এমন একটি সমস্যা গড়ে উঠল, যার সমাধান কেউ খুঁজে পেল না। সাবেকি সংস্কারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হল তাকে। কিন্তু দেখল, যে মানুষটির সমর্থন সে পাবে ভেবেছিল, সে তাকে সমর্থন করল না। এনিয়ে অনুতোষের সঙ্গে তার খিটিমিটি লাগতে লাগল। বাপ মরা একমাত্র মেয়ে রমিত। মায়ের কাছে তাকে কোনওদিন কোনও বিষয়ে হাত পেতে বিমুখ হতে হয়নি। এই পরাজয় তার মনে বড় আঘাত হানল। সে অভিমানে অনুতোষদের ঘর ছেড়ে চলে এল।
তারই দেহের রক্তকণিকায় গড়া একমাত্র সন্তান, ফুলের মতো ফুটফুটে ছোট্ট মেয়েটিকে জেদের বসে ছেড়ে এসেছিল সে। বুকের হৃৎপিণ্ড যেন ছিঁড়ে ফেলে এসেছিল সেদিন। মা হয়ে একমাত্র মেয়েকে ছেড়ে আসার যন্ত্রণা কারও কাছে কখনও বলতে পারেনি। রাতের পর রাত বালিশ ভিজিয়েছে চোখের জলে। তবুও তীব্র অভিমানে নিজের বুকে পাথর চেপে রেখেছিল। মেয়ের জন্য কোনও দাবি করেনি। মেয়ে তার বাবা আর ঠাকুমার কাছেই রয়ে গেল। আজ সে প্রায় ছ’বছরের হয়েছে। এখন দেখে হয়তো চিনতেও পারবে না। নিজের মেয়ে বলে সে কোনও দাবি করতে পারবে না। দাবি সে করেও না। জীবনে যে পাওয়াটুকু তার প্রাথমিক পাওনা ছিল, তাকেই ধরে রাখতে পারেনি, তার আবার সন্তান। নিজের কোনও ভবিষ্যৎ ছিল না বলেই মেয়েকে তার বাবার হাতেই রেখে এসেছিল। অনুতোষ ও তার মা সেটাই চেয়েছিলেন। রমিতাও মেনে নিয়েছিল। মেয়ে তার বাবার কাছেই ভাল থাকবে। এখনও মনের মধ্যে মেয়ের জন্য একটা কষ্ট হয়। সে কষ্ট তার একান্ত নিজের। বাইরের কেউ জানে না; জানবেও না।
এখন মনে হচ্ছে, তার মেয়ের জন্যই হয়তো তার কাছে এসেছে অনুতোষ। অনুতোষকে দেখেই ভেবেছিল, ফিরিয়ে দেবে। কিন্তু পারছে না। মনের মধ্যে একটা ইচ্ছা বারবার উঁকি দিচ্ছে। নিজের মেয়েকে দেখতে পাওয়ার প্রবল আকাঙক্ষা। মেয়ে। হয়তো জানবে না; সে তার মা। তবু সে তো একবার দেখার সুযোগ পাবে। এমনি করে একটা পরীক্ষার সামনে পড়তে হবে ভাবেনি কখনও। আজ মনে হচ্ছে, সেদিন ওভাবে হুট করে চলে না এলেই বোধহয় ভাল হত। কিন্তু তখন রাগের মাথায় অন্য কিছু ভাববার অবকাশ পায়নি। সেসব কথা মনে হয় বিগত জন্মের গল্প।