- বইয়ের নামঃ মদনভস্ম
- লেখকের নামঃ নীহাররঞ্জন গুপ্ত
- বিভাগসমূহঃ গোয়েন্দা কাহিনী
০১-০৫. জবানবন্দী দিচ্ছিল সুসীম
মদনভস্ম
উৎসর্গ-
কল্যাণীয়া করবী গুপ্ত (সীপু)
আশীর্বাদক বাবা
.
এই পুস্তকে বর্ণিত কোনও চরিত্রের সঙ্গে জীবিত বা মৃত কোন চরিত্রের কোন সম্পর্ক নাই এবং কোনও ঘটনা বা স্থানের সঙ্গেও কোন সম্পর্ক নাই।
-লেখক।
.
০১.
জবানবন্দী দিচ্ছিল সুসীম। বিষণ্ণ ম্লান মুখখানির দিকে তাকালে মনে হবে মাত্র কিছুক্ষণ আগেই বুঝি তার উপর দিয়ে। একটা ঝড় বয়ে গিয়েছে। অসহায় চোখের দৃষ্টি যেন যে-কোন একটা অবলম্বন খুঁজছিল।
অদূরে দাঁড়িয়েছিলেন সুসীমের ভগ্নীপতি হরপ্রসাদ। আর মুখোমুখিই প্রায় একটা চেয়ারে বসে থানা-অফিসার সাধন দত্ত একটির পর একটি প্রশ্ন করে যাচ্ছিলেন।
কতদিনের পরিচয় ছিল আপনাদের?
অনেক দিনের। মৃদুকণ্ঠে প্রশ্নের জবাবটা দিয়ে পার্শ্বেই দণ্ডায়মান হরপ্রসাদের দিকে একবার তাকাল সুসীম।
হরপ্রসাদও সঙ্গে সঙ্গে সায় দিলেন, হ্যাঁ, অনেক দিনের পরিচয় ওদের।
তবু কত দিনের?
তা ধরুন বারো বছর তো হবেই। কি বল সুসীম! হরপ্রসাদ সুসীমকেই যেন পাল্টা প্রশ্ন করলেন।
হ্যাঁ, তা হবে।
বারো বছর অনেক দিন বলুন!
হ্যাঁ, অনেক দিনের আলাপ ছিল ওদের পরস্পরের। কতকটা যেন পুনরাবৃত্তির মতই কথাটা বললেন হরপ্রসাদ।
হুঁ।
মনে হলো সাধন দত্ত যেন কি ভাবতে লাগলেন আপন মনেই।
মিঃ দত্ত!
সুসীমের মৃদুকণ্ঠের ডাকে মুখ তুলে তাকালেন সাধন দত্ত।
আমি এবারে বাইরে যেতে পারি?
হ্যাঁ, হ্যাঁ—যাবেন বৈকি, যান না।
সুসীম ঘর থেকে বের হয়ে আসবার জন্য পা বাড়াতেই সাধন দত্ত বললেন, সুসীমবাবু, আপনার স্ত্রীকে যদি এ ঘরে একবার পাঠিয়ে দেন!
সুসীম কিছু বলবার আগেই হরপ্রসাদ বললেন, নিশ্চয়ই, আমি ডেকে আনছি শ্রাবণীকে।
সুসীম আর দাঁড়াল না। ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
ঘরে একাকী শ্রাবণী বসেছিল।
পরিধানে বৌভাতের দামী সবুজ বেনারসী শাড়ি। গলায় জড়োয়ার হীরা ও মুক্তা বসানো হার, হাতে হীরা বসানো বালা, কানে হীরার কর্ণাভরণ। লাল শাঁখা, লোহা, রুলিও ছিল হাতে। কপাল জুড়ে সযত্ন-অঙ্কিত চন্দন-তিলক।
রাত্রি শেষ হয়ে আসছে।
খোলা জানালাপথে বাইরের সেই তরল অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বসে ছিল শ্রাবণী।
সুসীমের নববধূ শ্রাবণী।
হরপ্রসাদ এসে ঘরে ঢুকলেন।
হরপ্রসাদের পদশব্দে ফিরে তাকাল শ্রাবণী।
শ্রাবণী, মিঃ দত্ত তোমাকে আর একবার ডাকছেন।
কেন?
তা তো ঠিক জানি না। চল একবার।
জামাইবাবু?
বল?
কিছু জানতে পারা গেল?
কি?
কে—মানে বলছিলাম, কে তাঁকে হত্যা করলো?
না।
এখনো জানতে পারা গেল না?
না।
জানতে নিশ্চয়ই পারা যাবে না—
তা জানতে হবে বৈকি।
কিন্তু-–
কিছু বলছিলে?
না, কিছু না—চলুন।
হরপ্রসাদের পিছনে পিছনে ঘর থেকে বের হয়ে এলো শ্রাবণী।
সিঁড়ি দিয়ে উঠে উপরের যে ঘরে সাধন দত্ত বসেছিলেন, হরপ্রসাদের সঙ্গে সঙ্গে পুনরায় সেই ঘরে এসে ঢুকল শ্রাবণী।
আসুন মিসেস্নাগ। আবার আপনাকে বিরক্ত করতে হলো বলে আমি দুঃখিত। বসুন–
যন্ত্রচালিত একটা পুতুলের মতই যেন শ্রাবণী এগিয়ে গিয়ে নির্দিষ্ট খালি চেয়ারটায় সাধন দত্তর মুখোমুখি বসল।
আচ্ছা মিসেস্ নাগ, সে-সময় একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে মনে ছিল না আমার—
চোখ তুলে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল শ্রাবণী সাধন দত্তর মুখের দিকে নিঃশব্দে।
আপনি আপনার জবানবন্দীতে বলেছেন সুনন্দা চ্যাটার্জীর সঙ্গে আপনার পূর্বে পরিচয় ছিল–
হ্যাঁ।
কি সূত্রে আপনাদের পরিচয়?
কিছুদিন এক কলেজে পড়েছিলাম—
কিছুদিন মানে কতদিন হবে?
তা তিন বছর হবে।
ঘনিষ্ঠতা ছিল কি আপনাদের মধ্যে?
না। তাকে—তাকে আমার কোনদিনই ভাল লাগে নি।
ভাল লাগে নি! কেন?
তা-তা আমি বলতে পারবো না। তবে—তবে তাকে কখনো আমার ভাল লাগে নি। তবু–তবু আপনি বিশ্বাস করুন মিঃ দত্ত, আমি কখনো চাই নি তার এভাবে মৃত্যু হোক।
হুঁ। আচ্ছা মিসেস, নাগ, আপনাদের বিবাহের পূর্বে আপনার স্বামীর সঙ্গে যে সুনন্দা চ্যাটার্জীর পূর্ব-পরিচয় ছিল, আপনি কি তা জানতেন?
জানতাম।
খুব ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল নাকি ওদের শুনলাম!
আমিও তাই জানতাম।
আর একটা কথা, আপনি ঠিক জানেন—আপনাদের আজকের এই উৎসবে আপনার স্বামী তাকে প্রথমে নিমন্ত্রণ করেন নি?
জানি করে নি—
তারপর যেচে সে যে নিজে থেকে নিমন্ত্রণ নিয়েছিল—এ কথাটা কি আপনি শুনেছিলেন?
শুনেছি। আমার স্বামীই কাল রাত্রে আমাকে বলেছিল।
আচ্ছা আপনার কি মনে হয়, যেচে হঠাৎ অমন করে কেন সে নিমন্ত্রণ নিতে গেল?
কি করে বলবো!
আজ এখানে আসবার পর আপনার সঙ্গে নিশ্চয়ই তার দেখা হয়েছিল?
হয়েছিল।
কথাবার্তাও হয়েছিল নিশ্চয়ই?
হয়েছিল।
ও সম্পর্কে আপনাদের মধ্যে কোন কথা হয় নি?
না।
আপনি নিশ্চয়ই তার ঐভাবে যেচে নিমন্ত্রণ নিয়ে এখানে আসায় খুশি হতে পারেন নি!
সেটাই তো স্বাভাবিক।
তা বটে। আর একটা কথা—
বলুন।
এ ব্যাপারে কাউকে আপনার সন্দেহ হয়?
না।
আচ্ছা আপনি যেতে পারেন।
শ্রাবণী ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
দোতলার বারান্দা দিয়ে যেতে যেতে শ্রাবণী লক্ষ্য করল, তার স্বামী সুসীম রেলিংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
কিন্তু কি জানি কেন, স্বামীকে যেন দেখেও দেখলোনা শ্রাবণী। নিজের ঘরের দিকেই সে চলে গেল।
সুসীমও শ্রাবণীকে দেখে যেন ডাকতে গিয়েও ডাকতে পারল না।