- বইয়ের নামঃ বনমরালী
- লেখকের নামঃ নীহাররঞ্জন গুপ্ত
- বিভাগসমূহঃ গোয়েন্দা কাহিনী
০১. বাড়িটা তৈরি হয়েছিল
বাড়িটা তৈরি হয়েছিল বছর তিনেক আগেই।
একেবারে সাদার্ন অ্যাভিনুর উপর বাড়িটা। তিনতলার ছাদে উঠলে লেক চোখে পড়ে। জায়গাটা গগনবিহারী কর্নেল গগনবিহারী চৌধুরী কিনেছিলেন চাকরিজীবনেই। ইচ্ছা ছিল রিটায়ার করার পর বাকি দিনগুলো কলকাতা শহরেই কাটাবেন গগনবিহারী, স্ত্রী নির্মল্যর তাই একান্ত ইচ্ছা ছিল।
ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট যখন ঐ তল্লাটে জমিগুলো বিক্রি করছিল তখনই কিনেছিলেন জমিটা। সাড়ে চার কাঠা জমি।
চাকরি যখন আর বছর ছয়েক বাকি তখন বাড়িটা শুরু করেন। তারপর ধীরে ধীরে বাড়িটা তৈরী হয়েছে প্রায় চার বছর ধরে।
দোতলা বাড়ি।
উপরে চারখানা ঘর-নীচে চারখানা ঘর। একতলা ও দোতলার ব্যবস্থা সবই পৃথক, যদি কখনও একতলাটা ভাড়া দেন সেই মতলবেই সব ব্যবস্থা আলাদা করেছিলেন গগনবিহারী।
মিলিটারি চাকরির জীবনে সারা ভারত ঘুরে ঘুরে বেড়িয়েছেন আর্মির ইনফ্যান্ট্রি অফিসার কর্নেল চৌধুরী। কিন্তু ছাত্রজীবনে কলকাতার যে স্মৃতি তাঁর মনের মধ্যে আঁকা হয়ে গিয়েছিল কোনদিন তা বুঝি ভুলতে পারেননি।
কলকাতার একটি অদ্ভুত আকর্ষণ ছিল তাঁর মনের মধ্যে চিরদিন।
প্রায়ই বলতেন গগনবিহারী, দুর দুর, শহর বলতে কলকাতা শহর। বোম্বাই মাদ্রাজ দিল্লী আবার একটা শহর নাকি? প্রাণের স্পন্দন বলতে কিছুই নেই ওসব জায়গায়!
স্ত্রী নির্মাল্য হেসেছে।
নির্মাল্য বরাবর ইউ.পি.-তেই মানুষ। সে কিন্তু বলেছে, কলকাতা আবার একটা শহর! ঘিঞ্জি, ধুলো, মানুষের ভিড়।
কর্নেল চৌধুরী জবাবে বলেছেন, তবু শহর কলকাতা-কলকাতা শহরই!
বাড়িটা মনের মত করেই তৈরী করেছিলেন গগনবিহারী—সামনে খানিকটা ভোলা জায়গা, ফুলের বাগান থাকবে, তারপর ঘোট ঘোরানো একটা গাড়িবারান্দা।
নীচে ও উপরে বড় বড় দুটো হলঘর। চওড়া সাদা পাথরের সিঁড়ি।
দোতলায় হলঘরটার সামনে খানিকটা খোলা ছাদের মত—টেরেসা নামকরা এক আর্কিটেক্টকে দিয়ে বাড়ির প্ল্যানটা করিয়েছিলেন।
কন্ট্রাক্টারকে বলেছিলেন বাড়ি তৈরী শুরুর সময় গগনবিহারী, মিঃ বোস তাড়াতাড়ি বাড়িটা কমপ্লিট করে দেবেন। যতদিন না অবসর নিই চাকরি থেকে, ছুটিটায় ওখানে গিয়ে থাকবে।
কন্ট্রাক্টার মিঃ বোসও সেই মতই অগ্রসর হচ্ছিলেন। কিন্তু বাড়ি তৈরী শুরু হবার মাস-আষ্টেক পরে হঠাৎ নির্মাল্য একটা মোটর-অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেল।
স্ত্রীকে অত্যন্ত ভালবাসতেন কর্নেল চৌধুরী। স্ত্রীর আকস্মিক দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুটা তাই তাঁকে খুবই আঘাত দিল। জীবনটাই যেন অতঃপর তাঁর কাছে মিথ্যে হয়ে গেল।
একমাত্র সন্তান ছেলে রাজীব বিলেতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গিয়ে আর ফিরল না গগনবিহারীর বাড়ি তৈরী করবার ইচ্ছেটাই যেন অতঃপর কেমন ঝিমিয়ে গেল। কন্ট্রাক্টার মিঃ বোসকে তখন বললেন, তাড়াহুড়োর কিছু নেই, ধীরে-সুস্থে কমপ্লিট হোক বাড়ি।
মিঃ বোসও অতঃপর কাজে ঢিলা দিলেন। ধীরে ধীরে শম্বুকগতিতে কাজ চলতে লাগল। এবং বাড়ি শেষ হল দীর্ঘ চার বছর বাদে একদিন।
তখনও চাকরির মেয়াদ দুবছর বাকি রয়েছে। নতুন বাড়ি তালাবন্ধ হয়ে পড়ে রইল। একজন কেয়ারটেকার রইল—জানাল সিং। আরও দু বছর পরে চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর গগনবিহারী মাস-চারেক এদিক ওদিক ঘুরে অবশেষে এসে উঠলেন তাঁর বাড়িতে। এক শীতের অপরাহ্নে মালপত্র সব আগেই চলে এসেছিল। ভাগ্নে আর ভাইপোসুবিনয় সান্যাল ও সুবীর চৌধুরীকে। চিঠিতে লিখে জানিয়ে দিয়েছিলেন গগনবিহারী কিছু আসবাবপত্র কিনে বাড়িটাকে সাজিয়ে পরিষ্কার করে রাখতে।
চিঠিতে ওদের আরও লিখেছেন, ওরা যেন অতঃপর তাদের মেসের বাসা তুলে দিয়ে ঐখানেই এসে থাকে।
সুবিনয় সান্যাল আর সুবীর চৌধুরী একজনে মামার ও অন্যজনে তার কাকার নির্দেশ পেয়ে মনে মনে খুশিই হয়েছিল।
বালিগঞ্জ অঞ্চলে লেকের কাছে বড় রাস্তার উপরে অমন চমৎকার বাড়ি-খুশি তত হবারই কথা।
দুজনেরই অবস্থা যাকে বলে অতি সাধারণ।
সুবিনয় বি.এস.সি পাস করে এক ওষুধ কোম্পানীতে মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভের চাকরি করে—মাইনে শ-দুই টাকা।
গ্রামের বাড়িতে বিধবা মা ও ছোট বছর পনেরোর একটি বোন। মীজাপুর স্ট্রীটের একটা মেসে ফোর-সিটে রুমের একটা সীটে থাকত। আর সুবীর চৌধুরী আই.এ. পাস করে শর্টহ্যান্ড টাইপরাইটিং শিখে একটা দেশী ফার্মে চাকরি করে। সে-ও থাকত হাজরা রোডের একটা বোর্ডিং হাউসে।
তার আয়ও সামান্য। মাসান্তে শ-দেড়েক টাকা মাত্র। তবে তার সংসারে কেউ ছিল না। গগনবিহারীর স্কুলমাস্টার বড় ভাই বিজনবিহারীর ছেলে ঐ সুবীর। বিজনবিহারীর অনেক দিন আগে মৃত্যু হয়েছিল।
স্বামীর মৃত্যুর বছর ছয়েকের মধ্যেই স্ত্রীরও মৃত্যু হয়েছিল।
গগনবিহারী সুবীরকে মধ্যে মধ্যে অর্থসাহায্য করতেন তবে সে সাহায্যের মধ্যে খুব একটা, আগ্রহ বা প্রাণ ছিল বলে সুবীরের কখনও মনে হয়নি।
সুবীরও তার কাকা কর্নেল চৌধুরীকে জীবনে দু-একবারের বেশী দেখেনি। দুজনকেই আলাদা আলাদা করে চিঠি দিয়েছিলেন কর্নেল চৌধুরী।
তাঁর চিঠি পেয়ে সুবীরই মিজাপুর স্ট্রীটের মেসে গিয়ে এক সন্ধ্যায় সুবিনয়ের সঙ্গে দেখা করে।