- বইয়ের নামঃ অনন্ত দ্রাঘিমা
- লেখকের নামঃ অনিল ঘড়াই
- প্রকাশনাঃ দে’জ পাবলিশিং (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
খাটো ধুতি
অনন্ত দ্রাঘিমা – আশুতোষ মুখোপাধ্যায়
০১.
খাটো ধুতি হাঁটুর উপর চড়ানো, চুনারাম বাঁধের উপর উঠে এসে পিছন ফিরে তাকাল। যার হড়বড়িয়ে চনমনে ফড়িংয়ের মতো উড়ে বেড়ানোর কথা সেই রঘুনাথ হাঁপু ধরা দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে চুনারামের দিকে। আজকালকার ছেলেপুলেদের গায়ে তেমন জোর নেই, বালিছাতুর চেয়ে পলকা ওদের গতর, চুনারাম মোটা ঠোঁটে হাসি ছড়িয়ে কিছুটা নেমে এসে হাত বাড়িয়ে দিল, ধর দাদু, উঠে আয়। হা-দেখ, বেলা কেমন বাড়ছে। কখুন পৌঁছাব ক’ তো? চিন্তাটা চুনারামের একার নয়, এর সঙ্গে দুর্গামণির ভাবনাটাও দুধে-ঘোলে মিশে আছে। গুয়ারাম মাসের উপর ঘরছাড়া। গাঙ পেরিয়ে সে চলে গিয়েছে চাষের কাজে। প্রথম বর্ষায় এই ঝুঁকি নিয়ে ঘর ছাড়া তার উচিত হয়নি। শুধু দুর্গামণি নয়–চুনারামও বুঝিয়েছিল, যাসনি বেটা। মাটি হারালে দুঃখু বাড়ে। কথাটা মনে রাখিস। গরিবের কথা বাসি হলে কাজে লাগবে। বরাবরই একগুয়ে গুয়ারাম। নিজে যা বুঝবে সেটাই মক্কা-মদিনা, ছোট বড়কে তত বিশেষ পাত্তা দেয় না। দুর্গামণি অভিমান করে-মুখ ফোলায়, অত জেদ ভালো নয় গো, জেদ বুনো-মানুষকে ঝোড়-জঙ্গলে খেদিয়ে নিয়ে যায়। মাথা সামলাও, না হলে ঠকবে।
–মেলা খ্যাচরম্যাচর করো না তো, ভাল লাগে না। গুয়ারামের সব কথাতেই বিরক্তি। এই সংসারের কোনো কিছুই বুঝি তার ভালো লাগে না। মন মতো কথা না হলে বিরক্তিতে সে চাপানদী। মুখটা কুয়াশার গভীরে ঢুকে যায়। ধুতি সামলে পানসে হেসে চুনারাম রঘুনাথের দিকে তাকাল, কিরে, উঠে আয় দাদু। বেলা চড়ছে, সে খেয়াল কি তুর আচে। সময়ে ঘর না গেলে তুর মা কি বলবে বল তো!
কি আর বলবে, খেতে টুকে দেরি হবে। চোখ নাচিয়ে রঘুনাথ রগড় করে হাসল। ওর সারা গায়ে ধুলোভর্তি, তবু রোদ যেন পিছলে যায় ওর মাগুর মাছের গতর থেকে। ঝাঁকড়া মাথায় কুঁকড়ে আছে ওর মোটা মোটা কুচকুচে চুলগুলো। একেবারে দুর্গামণির মুখটা যেন বসানো, হাসিটাও ছাঁচের সন্দেশের মতো! চুনারাম দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, হতাশায় প্যানপেনিয়ে উঠল গলা, তুর জন্যি আর পারি না, আমারই ভুল হয়েচে তুরে সাথে করে নিয়ে আসা। এবার রাগে ফেস করে উঠল রঘুনাথ, নিয়ে এসেচো মানে? আমি কি তুমার ঘাড়ে চেপে এসেচি নাকি? আমি এসেচি-নিজের পায়ে। চরণবাবুর ট্যাকসি বোঝো? কিছু বোঝো না তুমি! বুড়া মানুষ…ছ্যা…!
হ অ। আমি বুঝিনি, তুই সব বুঝিস? তাচ্ছিল্যে ঠোঁট বেঁকে গেল চুনারামের, তবু বেশ ভালো লাগছিল তার। একমাত্র নাতি বলে কথা। লোকে বলে আসলের চাইতে সুদ মিষ্টি। কথাটা মন্দ বলে না। কত মানত করার পর রঘু এল। গুয়ারামের খুশি আর ধরে না। দৌড়ে এসে খবর দিল, খোকা হয়েছে বাবা, যাক এবার আটকুড়া অপবাদটা ঘুচল! চুনারামও খুশি হয়েছিল সে দিন। দোক্তা পান মুখে পুরে সে বিভোর হয়ে গিয়েছিল সুখে। ছেলের সুখ মানে তো তার সুখ। এই বয়সে এর চেয়ে আর কি চাই? শুধু লজ্জাবতীর জন্য দুঃখ হয়। সে এসব দেখে যেতে পারল না। তার ভাগ্যটাই ফোপরা, পোকায় কাটা, খরার আকাশ। রঘুর সাথে লড়তে খারাপ লাগে না চুনারামের। আর রঘুও সব সময় ওর পেছনে লেগে আছে। দাদু, এটা করে দাও, সেটা করে দাও। হেন-তেন সাত-সতেরো ফরমাশ। ঘরটা আলো করে আছে ছেলেটা। চুনারামের মান-অভিমান সব কিছু এখন এই নাতির উপর। রঘু সেটা বোঝে কিনা কে জানে। চুনারাম বাঁধের ঢালু পথ বেয়ে নেমে গেল সরসরিয়ে, রঘুনাথের হাত ধরে বলল, আর খুপড়িটা তেতিয়ে দিস নে, এবার চল। হা-দেখ কেমন চড়া রোদ উঠেচে, মনে হচ্ছে মাথার ঘিলু শুকিয়ে দেবে। চুনারাম খটখটে আকাশের দিকে তাকাল। চারদিকে কড়া রোদের হিলহিলানো সাপ নাচছে। গায়ে ছ্যাঁকা দেওয়া ফোঁসফোঁসানী হাওয়া! সেই বিষে চড়বড় করে চামড়া, গলা শুকায়, টান ধরে পেটে।
আর জেদ ধরে থাকা উচিত নয়! রঘুনাথ দু’হাতে ধুলো জেবড়ে উঠে দাঁড়ায়। এই সামান্য চড়াই উঠতে তার কিছু যায় আসে না। শুধু বুড়াটাকে তাতানোর জন্য তার এই মনগড়া নাটক। রঘুনাথ চুনারামকে খুশি করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ধরো গো! আর পারচি নে। বয়স হল, মাজা পড়লো-আর কতকাল এই শরীলটাকে ঠেলব?
মারব দুই থাপ্পড়, ইরকি হচ্ছে? চুনারামও নাটকে ওস্তাদ, ডান হাত উঠিয়ে সে ভঙ্গি করে দাঁড়ায়। রঘু তার ভঙ্গি দেখে বাঁধের নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া বুড়িগাঙের মতো খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। এক দমে জগৎখালি বাঁধের উপর উঠে এসে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সে ঠাট্টা করে বলে, দেখলে তুমারে কেমন ঘাবড়ে দিলাম। আমার সাথে লড়তে এসো না, হেরে যাবে।
হঅ, হঅ। হারবা তো হারবা। চুনারাম বুক হালকা করে শ্বাস ছাড়ল, এবার চল দেখি ঝটপট। নালফুল তুলতে হবে। তুই পারবি তো দাদু?
–পারব না মানে, ঢের পারব।
–আমি কিন্তু জলে নামবনি। কাল আমার ঘুসঘুসিয়া জ্বর এয়েছিল। রাতভর জ্বরের ঠেলায় কুঁকড়ে-মুকড়ে পড়ে ছিলাম। ভোরের আলো ফুটতে শরীরটা টুকে হালকা হল। চুনারাম রঘুনাথের পাশাপাশি হাঁটছিল। নাতির মন পাওয়ার চেষ্টা করছিল কিন্তু অন্যপ্রান্ত অসাড় দেখে তার কথা বলার ইচ্ছেটাই শ্মশানমুখো হয়ে গেল।