- বইয়ের নামঃ গীতি-শতদল
- লেখকের নামঃ কাজী নজরুল ইসলাম
- বিভাগসমূহঃ প্রবন্ধ
অবুঝ মোর আঁখি-বারি
তিলক-কামোদ – ঠুংরি
অবুঝ মোর আঁখি-বারি
আমি রোধিতে নারি॥
গলেছে যে নদীজল
কে তারে রোধিবে বল,
পাষাণের সে নারায়ণ
তবু সে আমারই॥
অসুর-বাড়ির ফেরত এ মা
ভৈরবী একতালা
অসুর-বাড়ির ফেরত এ মা
শ্বশুরবাড়ির ফেরত নয়।
দশভুজার করিস পূজা
ভুলরূপে সব জগৎময়॥
নয় গৌরী নয় এ উমা
মেনকা যার খেত চুমা,
রুদ্রাণী এ, এ যে ভূমা,
এক সাথে এ ভয়-অভয়॥
অসুর দানব করল শাসন
এইরূপে মা বারে বারে
রাবণ-বধের বর দিল মা
এইরূপে রাম-অবতারে।
দেব-সেনানী পুত্রে লয়ে
যায় এই মা, দিগ্বিজয়ে
সেইরূপে মায়ের কর রে পূজা
ভারতে ফের আসবে জয়॥
আঁখি ঘুম-ঘুম নিশীথ নিঝুম ঘুমে ঝিমায়
ভৈরবী তালফেরতা
আঁখি ঘুম-ঘুম নিশীথ নিঝুম ঘুমে ঝিমায়।
বাহুর ফাঁদে স্বপন-চাঁদে বাঁধিতে চায়॥
আমি কার লাগি
একা নিশি জাগি
বিরহ-ব্যথায়।
কোথায় কাহার বুকে বঁধু ঘুমায়।
কাঁদি চাতকিনি বারি-তৃষায়।
কুসুমগন্ধ আজি যেন বিষমাখা হায়॥
কেন এ ব্যথা এ আকুলতা
পরের লাগি এ পরান পুড়ে,
মরুভূমিতে বারি কভু কি ঝুরে।
আমি এবার যেন মরে আসি তারই রূপ ধরে
সে যাহারে চায়॥
আজ লাচনের লেগেছে যে গাঁদি গো
পল্লি নৃত্যের গান
আজ লাচনের লেগেছে যে গাঁদি গো
আজ লাচনের লেগেছে গাঁদি।
আমার কোমর কাঁকাল ভেঙে গেছে
লেচে লেচে ও দাদি।
আজ লাচনের লেগেছে গাঁদি॥
মাদলের বোল : হুর্র্ হুর্রে দাদা, দাদারে দাদা!
তিন দাদা পুত নাতিন নাচে
দাদারে দাদা!
নাতিন নাচে পুতিন নাচে
সতিন নাচে শ্যাওড়া গাছে দাদারে দাদা!
তিন দাদা পুত নাতিন নাচে॥
বড়কি নাচে ছুটকি নাচে
মুটকি নাচে ধাতিং তিং,
শুঁটকি নাচে থুপি নাচে
নাচে সাথে আহ্লাদি।
আজ লাচনের লেগেছে গাঁদি॥
মাদলের বোল : ও গিজে, মুড়কি ভিজে!
ও গিজে রেল ঠুকে দে!
শিরীষের বাগান-ধারে
হাত বাড়ালে পয়সা পড়ে!
ওরে আমার ফকির চাঁদ
গাই দুয়োব বাছুর বাঁধ॥
বুড়ি নাচে ভুঁড়ি নাচে নাচে ছোঁড়াছুঁড়ি গো,
গোদা পায়ে ঘুঙুর বাঁধে নাচিছে খাঁদা-খাঁদি।
আজ লাচনের লেগেছে গাঁদি॥
মাদলের বোল : ও গিজে যাসনে ভিজে,
ও গিজে ঠানদিদি যে!
সাবাস বেটি বকন-ছা
কলামোচায় ফড়িং খা।
ও গিজে তাল ভটাভট!
ও গিজাং ঘিচতা ঘিচাং ঘিচতা ঘিচাং!
ও গিজে যাচ্চলে যা বরিশাল্যা
পাবনা ঢাকা খুলন্যে জেলা!
তেহাই : পিঁয়াজ পিঁয়াজ রসুন খাক
যার পাঁঠা তার বাপের গোয়ালে যাক,
খাক কাঁকুড় খাক
তোর ছেলে তোর দাদার ছেলে॥
হুল্লোড় ধ্বনি : দে গোরুর গা ধুইয়ে!
আজও ফোটেনি কুঞ্জে মম কুসুম
জংলা খেমটা
আজও ফোটেনি কুঞ্জে মম কুসুম
ভোমরাকে যেতে বল।
সখী গুঞ্জরি ফেরে কেন কুঞ্জে
বৃথাই এত ছল॥
কত কী শুনিয়ে যায় গুনগুনিয়ে হায় –
পাতার ঝরোকায় ঘোরে সে অবিরল॥
আমার প্রাণের ভিতর কেন ওঠায় সে ঝড়,
তারে ফেরালে ফেরে না হাসে কেবল,
সে ফিরিয়া গেলে চোখে আসে জল।
এ কী হল দায় আঁখি নাহি চায়
না দেখিলে তায় প্রাণ পাগল॥
আজকে হোরি ও নাগরী
হোরি দাদরা
আজকে হোরি, ও নাগরী
ওগো গিন্নি ও ললিতে॥
ফাগের রাঙা জল ভরে দাও
ফরসি হুঁকোর পিচকিরিতে॥
গাজর বিট আর লাল বেগুনে
রাঁধবে শালগম তেলে নুনে,
রাঙা দেখে লঙ্কা দিয়ো
লাল নটে আর ফুল-কারিতে॥
গাইব গান দোল পৃর্ণিমাতে
মালোয়ারি জ্বর আসলে রাতে,
তুমি দোহার ধরবে সাথে,
গিঁটে বাতের গিটকিরিতে,
আমি লাল গামছা পরে যাব
লাল-বাজারে পায়চারিতে,
তুমি যাবে চিড়িয়াখানায়
এই মুখেতে গন্ডার মারিতে,
না হয় তুমি যাও বাপের বাড়ি
পাছু পাছু যাব আমি শ্বশুর-বাড়িতে॥
আজি নন্দদুলালের সাথে
খাম্বাজ-কাফি হোরি কাহারবা
আজি নন্দদুলালের সাথে
খেলে ব্রজনারী হোরি।
কুঙ্কুম আবির হাতে
দেখো, খেলে শ্যামল খেলে গোরী॥
থালে রাঙা ফাগ
নয়নে রাঙা রাগ,
ঝরিছে রাঙা সোহাগ
রাঙা পিচকারি ভরি॥
পলাশে শিমুলে ডালিম ফুলে
রঙনে অশোকে মরি মরি।
ফাগ-আবির ঝরে তরুলতা-চরাচরে,
খেলে কিশোর কিশোরী॥
চাঁদ রূপালি থালে জোছনা-আবির ঢালে
রঙে রাঙা চকোর চকোরী।
দোলন চাঁপার শাখে দোয়েলা শ্যামা ডাকে
আজি দোল-পূর্ণিমা স্মরি॥
আজি প্রথম মাধবী ফুটিল কুঞ্জে
কীর্তন
আজি প্রথম মাধবী ফুটিল কুঞ্জে
মাধব এল না সই।
এই যৌবন-বনমালা কারে দিব
মোর বনমালী বই॥
সারা নিশি জেগে বৃথাই নিরালা
গাঁথিলাম নব মালতীর মালা,
অনাদরে হায় সে মালা শুকায়
দেখিয়া কেমনে রই॥
মম অনুরাগ-চন্দন ঘষে,
লাজ ভুলে সাঁঝ হতে আছি বসে,
শুকাইয়া যায় চন্দন হায়
রাধিকা-রমণ কই॥
চলিলাম আমি যথা প্রাণ চায়,
প্রভাতে আসিলে মোর শ্যামরায়
বলিস আঁধারে হারাইয়া হায়
গেছে রাধা রসময়ী॥
আজি মিলন-বাসর প্রিয়া
দ্বৈত গান
পুরুষ॥ আজি মিলন-বাসর প্রিয়া
হেরো মধুমাধবী নিশা।
স্ত্রী॥ কত জনম-অভিসার শেষে
প্রিয় পেয়েছি তব দিশা॥
পু॥ সহকার-তরু হেরো দোলে
মালতী লতায় লয়ে বুকে,
স্ত্রী॥ মাধবী-কাঁকন পরি
দেওদার তরু দোলে সুখে।
উভয়ে॥ হায় প্রাণ কানায় কানায় আজি পুরে
হিয়া আবেশ-পুলক-মিশা॥
পু॥ শরাব-রঙের শাড়ি পরেছে চাঁদনি রাতি,
স্ত্রী॥ তারার রূপে গলে পড়ে গগনে চাঁদের বাতি,
পু॥ হল জোছনা-শিরাজি রঙিন
স্ত্রী॥ নীল আকাশের শিশা॥
পু॥ হেরো জোয়ার-উতলা সিন্ধু পূর্ণিমা চাঁদেরে পেয়ে,
স্ত্রী॥ কোন দূর অতীত স্মৃতি মম প্রাণে-মনে ওঠে ছেয়ে।
উভয়ে॥ মিলন-ঘন-মেঘলোকে আজি মিটিবে মরু-তৃষা॥