- বইয়ের নামঃ এবং মার্কেট ভিজিট
- লেখকের নামঃ অভীক সরকার
- বিভাগসমূহঃ রচনাবলী
এবং মার্কেট ভিজিট
উৎসর্গ
ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায়ের করকমলে।
লেখকের কথা
ঐতিহাসিক তপন রায়চৌধুরী তাঁর ”রোমন্থন” নামের অসামান্য আত্মজীবনীমূলক রম্যরচনাটির শুরুতে লেখকের বক্তব্যের শীর্ষনাম দিয়েছিলেন ‘প্রারম্ভিক মুখব্যাদান’, যুক্তি ছিল মুখখোলাকে মুখবন্ধ বলা নিতান্তই অর্থহীন। প্রাজ্ঞ পণ্ডিতপ্রবর যে কথা বলে অনায়াসে পার পেয়ে গেলেন, এবং তাবৎ পাঠকেরা ”কেয়াবাৎ, বহোত খুব” বলে সোল্লাসে শাবাসি দিয়ে উঠলেন, এই অর্বাচীন সে কথা বললে অনেক রসিকজনই যে আমার মুখ বন্ধ রাখার পক্ষেই মত দেবেন এ বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ।
কিন্তু লেখককে কিছু কৈফিয়ত দাখিল করতেই হয়। যদিও প্রকাশক মশাই এই মাগ্যিগণ্ডার বাজারে কয়েকটা পাতা ফালতু ফালতু নষ্ট করার পক্ষপাতী ছিলেন না, কিন্তু প্রথা। তাছাড়া জাতে বাঙাল, কথা কইবার সুজুক পাইসি, ছারুম ক্যান?
আমার লেখা বই বার হবে এ স্বপ্ন আমি কোনওদিন দেখিনি। বস্তুত লেখক হবার ইচ্ছে বা লেখক তকমাটির প্রতি মোহ, দুটির কোনওটিই আমার কখনো ছিল না, আজও নেই। আমি চাকরিজীবী ছাপোষা মধ্যবিত্ত। নিজের চাকরি,যৎসামান্য পড়াশোনা আর নিভৃত গৃহকোণটি নিয়ে ভারি সুখেই ছিলাম। এহেন দুর্মতি যে কখনও হবে তার কোনও পূর্বলক্ষণই ছিল না। ছোটবেলায় ভারি রুগ্ন ছিলাম বলে খেলাধূলায় বিশেষ সুবিধা করতে পারতাম না। সেই বয়সে বড়দের চোখরাঙানি তাও মেনে নেওয়া যায়, সমবয়সীদের টিটকিরি মেনে নেওয়া বড়ই দুঃসহ। ফলে আমাকে একটা নিজের একটা আলাদা জগৎ তৈরি করে নিতে হয়। সেই জগতের একচ্ছত্র অধিপতি রাজা রায়চৌধুরী বলে একটা খোঁড়া লোক, সঙ্গী হিসেবে দুই দাদা, প্রদোষ মিত্র এবং ভজহরি মুখুজ্জে। সে জগতে ষষ্ঠীঠাকুরুন ধরা পড়ার ভয়ে ক্ষীরের পুতুলের বদলে একটি ষেটের বাছা দিয়ে যান, সে জগতে এক বাচ্চা রিপোর্টার আর তার পোষা কুকুর শেখায় যে অত্যাচারীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোটাই সত্যিকারের সাহস। সেই জগতে আরও ছিল ভারি মিষ্টি কিছু ভূত, কবরে শুয়ে থাকা এক পাগলা সাহেব, পাতালঘরে এক্সপেরিমেন্ট করা এক বৈজ্ঞানিক, পুরোনো মায়াভরা কিছু গ্রামগঞ্জ যেখানে সদাসর্বদাই নানা মজার কাণ্ড ঘটে চলেছে।
আর এসবের মধ্যে ছিলেন গোল চশমা পরিহিত এক ভদ্রলোক, তাঁরই বানানো এক আশ্চর্য দুনিয়া নিয়ে।
সুকুমার রায়।
সেই নিজের বানানো জগৎ থেকে আজও পরিত্রাণ পাইনি, পাওয়ার যে খুব ইচ্ছে আছে তাও নয়। আমি পাঠক, পাঠক হিসেবেই ভারি তৃপ্ত ছিলাম।
এমন সময়ে, আমি তখন ঠিক কচিটি নই, চাকরিজীবনে প্রবেশ করেছি, এমন সময়ে ফেসবুক নামের সোশ্যাল মিডিয়াটি এসে দুদিনের মধ্যে জনচিত্ত জয় করে বসলো। পোস্ট, স্টেটাস, লাইক, শেয়ার, এই বহুলপ্রচলিত শব্দগুলির সংজ্ঞাই গেলো বদলে।
সমাজজীবনে ফেসবুক আদি বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ার অভিঘাত নিয়ে ইতিমধ্যে গবেষণা চলছে, আরও নিশ্চয়ই চলবে। আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে ফেসবুকের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান হলো আমরা যারা স্কুল ও কলেজ জীবনের পর বাংলা ভাষা পড়া বা লেখা ভুলেই গেছিলাম, তাদের ফের ফেসবুকের লেখালেখির মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যের দিকে টেনে আনা। আমার এক অনুজপ্রতিম সাংবাদিক এর নাম দিয়েছেন মুক্তগদ্য। বস্তুত ফেসবুকের দৌলতে এমন কিছু চমৎকার গদ্য বা পদ্য পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে যা আক্ষরিক অর্থেই মণিমুক্তোর সমান।
এমন সময় নিজেরও বাংলা অক্ষরে ফেসবুকে কিছু লেখার বাসনা দুর্মদ হয়ে ওঠে। কবে এবং ঠিক কি কারণে এই ‘রেখো মা দাসেরে মনে’ আবেগটির উদ্ভব ঘটে, বলা মুশকিল। তবে মোটামুটি আজ থেকে বছরখানেক আগে হবে, যখন আমি প্রথম বাংলা অক্ষরে কিছু লিখি। ততদিনে আমি বেশকিছু সাহিত্যমূলক গ্রুপেও ঢুকেছিলাম। তাদেরই একটিতে অসীম সাহসে ভর করে আমি দুয়েকটি নিজস্ব অভিজ্ঞতা লিখতে শুরু করি। আমার এক প্রাচীনা বান্ধবী (না তিনি বয়সে প্রাচীনা নন, প্রাচীনকাল থেকে আমার বান্ধবী) ‘তুমি ঠিক যে ভাবে কথা বলো, সেভাবে লেখো’ গোছের পরামর্শ দেন। খুব সম্ভবত আমার আজন্মকালের ছ্যাবলামির ওপর তাঁর ঐকান্তিক আস্থা ছিল। আশ্চর্যের সঙ্গে দেখলাম বেশ কিছু লোকজন পছন্দ করছেন। দু একজন গুরুস্থানীয় লোক উৎসাহ দিতে লাগলেন। ফলে এই উদ্বাস্তু গরীব বাঙাল উত্তেজনায় ফেটে পড়ে ‘যায় যদি জীবন চলে’ স্লোগান তুলে মহোৎসাহে লেখালেখি শুরু করে দিলেন!
আদতে আমি সেলসের লোক, দশ বছরের ওপর হলো এ লাইনে আছি। দেশ দেখেছি প্রচুর, লোক দেখেছি আরও বেশি। অনেক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা হয়েছে, ভারতবর্ষ নামের এই ভূখণ্ডকে চিনেছি আরও নিবিড়ভাবে। সেসব অভিজ্ঞতাই এক এক করে ‘ভালোবেসে সখী নিভৃত যতনে’ গল্পের আকারে লেখার চেষ্টা করেছি বার বার। এছাড়াও কিছু ছোটগল্প, আমার শিশুকন্যার সঙ্গে আমার কিছু চিত্তাকর্ষক আলোচনাও রয়ে গেছে একইসঙ্গে।
তারপর বছরখানেক কেটে গেছে। নিজের টাইমলাইনে এবং বিভিন্ন গ্রুপে আজন্মসঞ্চিত ইয়ার্কি ফাজলামি গুলো লোষ্ট্রবৎ নিক্ষেপ করেই চলেছি। অনেকেই বাংলাসাহিত্যের কমলবনে এই মত্তমাতঙ্গের বালখিল্য বিচরণ দেখে শোকসাগরে নিমজ্জিত হয়েছেন, অজ জাতীয় প্রাণীর পক্ষে হলকর্ষণ যে তেমন সুফলপ্রদ নহে, মিষ্টভাষে এ কথা বুঝিয়ে দিতে ছাড়েন নি। এহ বাহ্য, যেসব মহাত্মনদের চিন্তা সদাসর্বদাই তূরীয়মার্গে বিচরণ করে, সেই তাঁরা এহেন অপরিসীম ঔদ্ধত্যের পেছনে দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীলদের কালো হাত দেখে চ্যাটরুমে চ্যাটচ্যাটে থিসিস অবধি নামিয়ে ফেলতে ছাড়েননি!