- বইয়ের নামঃ ৭১ এর রোজনামচা
- লেখকের নামঃ আহসান হাবীব
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
৭১ এর রোজনামচা – আহসান হাবীব
প্রথম প্রকাশ একুশে গ্রন্থমেলা ২০১২
আহসান হাবীব। জন্ম সিলেট, ১৯৫৭ সাল। ৫ই নভেম্বর। পড়াশুনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। থেকে ভূগোলে মাস্টার্স। ব্যাংকার হিসেবে। জীবন শুরু করে পেশা বদল কার্টুনিস্ট হিসেবে। বর্তমানে উন্মাদ ও ট্রাভেল এন্ড ফ্যাশনের সম্পাদক। পাশাপাশি রম্য লেখক। ব্যক্তিগত। জীবনে স্ত্রী আফরোজা আমিন ও কন্যা এষাকে। নিয়ে পল্লবীতে বসবাস করছেন।
উৎসর্গ : মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের।
ভূমিকা
একাত্তরে আমি ক্লাশ সিক্সের ছাত্র। আমাদের পরিবারটা তখন নানা ভাবে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। এই সময় আমি ডায়েরী লিখতাম একটা। সাদা খাতায়। যা যা দেখতাম বা শুনতাম লিখে ফেলতাম। স্বাধীনতার পরও খাতাটা ছিল। তারপর আর একসময় পেলাম না। এখন আফসোস হয় খাতাটা থাকলে অনেক ঘটনা জানা যেত। কিছু কিছু ঘটনা আমার এখনো মনে আছে। ভাবলাম, আচ্ছা লিখে রাখলে কেমন হয়? এক সময়তো এগুলিও হারিয়ে যাবে। তরুণ প্রজন্ম বরং জানুক আমরা কী সময় পার হয়ে এসেছি। সেই সময়কার বিচ্ছিন্ন ঘটনা নিয়ে এই একাত্তরের রোজনামচা… কিছু কিছু ঘটনা আবার ইদানিংকালে শোনা। এগুলোর বেশীর ভাগই অনিক খানের তবুওতে ছাপা হয়েছিল।
*
গভীর রাতে এক হিন্দু প্রধান গ্রামে হামলা করল পাক আর্মী। গুলি আর আগুন দিয়ে তছনছ করে দিল গ্রামটাকে। সবাই পালাচ্ছে। পাশেই বিশাল নদী। যদি নৌকা দিয়ে কোন মতে পার হওয়া যায় নদীটা তবেই জানে বাঁচা যেতে পারে। রাতের অন্ধকারে সবাই ছুটছে নদীর দিকে। রমাকান্ত তার স্ত্রী আর ছোট দুই পুত্র-কন্যা নিয়ে ছুটছেন। মেয়েটি কোলে ছেলেটার হাত ধরে রেখেছেন মা। হঠাৎ মুখ থুবড়ে পড়লেন মা।
–কি হল? রমাকান্ত হতভম্ব।
‘আমার গুলি লেগেছে’ কোনমতে বললেন স্ত্রী সুধা। বুকের কাপড় থিক থিক করছে রক্তে।
‘তুমি ওদের নিয়ে পালাও’ কোনমতে বললেন স্ত্রী।
রমাকান্ত দেরী করলেন না, ছেলে মেয়ের হাত ধরে ছুটছেন। নদীর ঘাটে নৌকা বেশী ছিল না। সবাই হুড়োহুড়ি করে উঠছে। একটায় কোনমতে উঠলেন রমাকান্ত। শক্ত করে ধরে রেখেছেন ছেলে আর মেয়েকে। নদীটা পার হতে পারলে হয়। নৌকা চলতে শুরু করল। মাঝ নদীতে হঠাৎ মর্টারের শেল আঘাত হানল নৌকায়, ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল নৌকাটা। রমাকান্ত ছেলে আর মেয়ে নিয়ে ডুবে গেলেন উত্তাল নদীতে। দু’হাতে দু’জনকে ধরে রেখে কোনমতে ভেসে থাকার চেষ্টা করলেন। কিন্তু তিনি পারছেন না। যে কোন একজনকে ছেড়ে দিলে হয়ত বেঁচে যেতে পারেন। কিন্তু কাকে ছাড়বেন? ছেলেকে না মেয়েকে? দ্রুত চিন্তা চলছে তার মাথায়। তিনি অন্ধকার রাতে নদী আর চোখের পানি এক করে মেয়েটাকেই ছেড়ে দিলেন। তিনি কী ভেবে ছেড়েছিলেন মেয়েটিকে? হয়ত ভেবেছেন মেয়েতো একসময় পরের ঘরে চলেই যাবে বরং ছেলেটাই থাক শেষ বয়সে বাবাকে দেখবে… এমনটা? মেয়েটি ভেসে গেল। তিনি এক হাতে ছেলেটিকে ধরে উত্তাল নদী সাঁতরে কোন মতে অন্য পাড়ে উঠে এলেন। আর আশ্চর্য হয়ে আবিষ্কার করলেন তিনি ডান হাতে ধরে আছেন তার মেয়েটিকে। তিনি রাতের অন্ধকারে ছেলেটিকেই ছেড়ে দিয়েছিলেন, বুঝতে পারেন নি!
*
তরুণ ছেলে মুক্তিযুদ্ধে যেতে চায়। বাবার মন সায় দেয় না। তার চুপচাপ ঘরোয়া ছেলেটি কি পারবে ভারতে গিয়ে ট্রেনিং নিয়ে যুদ্ধ করতে? কিন্তু বাবা জানেন না। ছেলে গোপনে ঢাকায় গেরিলাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে একের পর এক অপারেশন করে চলেছে। ছেলে যে গভীর রাতে ফিরে স্টেনগান লুকিয়ে রাখে তার ঘরে সেটাও তিনি জানেন না। বাবা কেন তাদের বাসার কেউই জানেন না তাদের বড় ছেলে গোপনে এক ভয়ঙ্কর মুক্তিযোদ্ধা। চলছিলো ভালোই। কিন্তু হঠাৎ একদিন ছেলের দুই বন্ধু এলো তার খোঁজে। মা চেনেন তাদের। খুশিও হলেন তাদের দেখে- কতদিন পর এলো তারা। তাদের দুপুরে খেতেও দিলেন। খেয়ে দেয়ে তারা ফিরেও গেলো হাসিমুখে। বলে গেলো, “খালাম্মা পারভেজকে বলার দরকার নেই আমরা এসেছিলাম, আমরা আবার আসব।” সহজ সরল মা বুঝতেই পারলেন না তারা আলবদর।
সে রাতেই আবার তারা এলো। এবার তাদের হাতে অস্ত্র, ভাবভঙ্গিও অন্যরকম। বাইরে অপেক্ষা করছে সাদা মাইক্রোবাস। কোন কথা নেই, পারভেজকে জোর করে ধরে তুলল সাদা মাইক্রোবাসে… ছোট ভাই ফিরোজ ছুটে গেলো, ভাইয়াকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? ওরা হ্যাঁচকা টানে ছোটভাই ফিরোজকেও তুলে নিলো। দিনটা ছিলো ১৪ই ডিসেম্বর। তার দুদিন পরে ১৬ই ডিসেম্বর। দেশ স্বাধীন হয়ে গেলো! রক্তস্নাত স্বাধীন বাংলায় ফিরে এলো না শুধু তারা দুই ভাই…।
*
পাকিস্তানী বাহিনী বাবাকে হত্যা করতে নিয়ে গেলো। বাবার চোখ বাঁধা। বাবার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি মুক্তিযযাদ্ধাদের সহযোগীতা করেছেন। রাজাকাররাই তাকে ধরে এনেছে। বাবাকে দাঁড় করানো হলো গুলি করার জন্য। হঠাৎ কোত্থেকে খবর পেয়ে ছুটে এলো তার কিশোর পুত্র। দুহাতে জরিয়ে ধরল বাবাকে, চিৎকার করে বলল, “আমার বাবাকে মেরো না, আমার বাবাকে মেরো না।” মিলিটারীর নির্দেশে কিশোর ছেলেটিকে টেনে হিঁচড়ে সরানো হলো। ছেলেটি আবার ছুটে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে উঠলো- “আমার বাবাকে মেরো না, আমার বাবাকে মেরো না।” এবারও তাকে টেনে-হিঁচড়ে সরানো হলো। আবারও একই ঘটনা ঘটলো। এবার মিলিটারীরা নির্দেশ দিলো গুলি করার। গর্জে উঠলো কয়েকটা রাইফেল। ছিটকে পড়লো বাবা আর ছেলে এক সঙ্গে। সবাই আশ্চর্য হয়ে দেখলো কিশোর ছেলে বাবাকে জড়িয়ে ধরে থাকলে… আর ভয়ঙ্কর মৃত্যু তাদের গ্রাস করলো একসঙ্গে।