সামনের দরজাটা খোলার আওয়াজ পেল কার্ল। একচিলতে আলো ছড়িয়ে পড়ল বাইরে, তারপর ফ্রেড হালামের ছায়া এর অধিকাংশই দখল করে নিল। নীচের পোর্চে তার পা ফেলার শব্দ শোনা যাচ্ছে। কে? রূঢ় স্বরে প্রশ্ন করল সে। কথা বলছ না কেন?
আলোর কিনারে এগিয়ে এল হার্ভে, কার্ল দেখল ওর রুক্ষ, সন্দিহান চোখজোড়া কোটর ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। লাইল ক্যানাডা, তোমার সঙ্গে দেখা করতে চায়।
ক্যানাডা? আমি তার সাথে দেখা করার কোন কারণ দেখছি না।
এখন আমাকে দেখছ তুমি, আলোয় এসে বলল ক্যানাডা। দাড়িগোঁফে ঢাকা মুখখানা এবার দেখতে পেল কার্ল, ঠোঁটের কোণে ঝুলে থাকা অস্থির ধূর্ত হাসিটা চিনতে পারল। আমার কথা শুনলে তোমারই লাভ-এর সাথে আইনের প্রশ্ন জড়িত।
তুমি আইনের লোক নও।
আমিও তা বলিনি। টাওসের এক আস্তাবলে কাজ করি আমি, সেখানে
এ কথা বলতে তুমি ছুটে আসনি এতদূর।
পাগল! এত ভাল একটা চাকরি ছেড়ে এসেছি যখন ব্যাপার নিশ্চয় গুরুতর। লোক আছে আমার সঙ্গে-ডিটেকটিভ গ্রীন। টাওসের হুইলার স্টেজ কোম্পানি ডাকাত ধরার জন্য, ঠিক করেছে ওকে। ডাকাতরা ওদের একটা স্টেজ লুট করার সময় একজন যাত্রীকে খুন করে।
কথাগুলো আলোড়ন তুলল কার্লের মগজে; ওর বাবার বক্তব্য ও শুনতে পেল। ধড়ফড় করছে বুক, দ্রুত শ্বাস পড়ছে, আচমকা মাথা ঘুরে, উঠতে দেয়ালে হেলান দিয়ে টাল সামলাল ও। একসময় ক্যানাডার অট্টহাসি শুনতে পেল সে। লোকটা বলছে, জানতে চাইলে টাকা খরচ হবে তোমার। ইচ্ছে করলে আজ রাতেই কিনে নিতে পার তথ্যটা, নয়তো কাল সকালে মার্শালের কাছেই শুনবে। তবে তখন হয়তো কিছুই করার থাকবে না তোমার।
মুহূর্তের নীরবতা। তারপর ওর বাবা যখন মুখ খুলল কার্লের বাকি আশাভরসাও উবে গেল। কত? কর্কশ কণ্ঠে প্রশ্ন করল ফ্রেড ছালাম।
এক হাজার। নগদ। এখনকার বাজারে তোমার বিশটা গরুর দাম। টাকা না দেখা অবধি মুখ খুলছি না আমি। আর হ্যাঁ, কথাটা যেন আমাদের এই তিনজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে।
উদ্বিগ্ন স্বরে হারে প্রশ্ন করল, ছেলেটা কোথায়, ফ্রেড?
আজ সকালে বলল শহরে যাচ্ছে, রাতে বাইরেই থাকবে। তুমি ছিলে তখন, তুমিও শুনেছ।
আমরা যখন বাইরে ছিলাম তখন ফিরেও এসে থাকতে পারে। তুমি ঠিক জানো, ও ঘরে নেই?
হালাম বলল, দাঁড়াও, তারপর পারলার হয়ে সিঁড়িতে ওর পদশব্দ পাওয়া গেল। কার্ল! ল্যান্ডিং থেকে ভেসে এল ডাক। কার্ল!
বাবার ওপর টেক্কা দিয়েছে ভেবে চাপা উল্লাস বোধ করল কার্ল। সকালে শহরে যায়নি সে, গিয়েছিল কার্লোস আর ডিউকের সঙ্গে দেখা করতে গার্সিয়াদের পুরানো শীপ র্যাঞ্চে। ওরা ছিল না সেখানে অগত্যা বাসায় ফিরে আসে ও। টের পেয়েছে লোকজনসহ ফিরে এসেছে ওর বাবা, কিন্তু রাতের খাওয়া খেতে ও বেরোয়নি নিজের ঘর থেকে, বিষণ্ণ মনে কেবলই ভেবেছে কার্লোস আর ডিউক হয়তো শেষপর্যন্ত চলেই গেছে দেশ ছেড়ে।
ওর ঘরের দরজা খুলে গেছে শুনতে পেল ও, তারপর রুক্ষ কর্তৃত্বসুলভ গলায় আবার ডাকল ওর বাবাঃ কার্ল! থাকলে, জবাব দাও।
বাবাকে যেন দেখতে পাচ্ছে সে, মনে হলো ওর, বিশাল চওড়া শরীর, চৌকো মুখখানা,থমথম করছে, চোখ দুটো কঠিন। সহসা ভয়ে শুকিয়ে গেল ওর বুক, তারপর এক মুহূর্ত বাদে শুনতে পেল তাচ্ছিল্যের সুরে অব্যক্ত একটা শব্দ করল ওর বাবা, ঘুরে চলে গেল সিঁড়ির পানে।
সামনে ঝুঁকল কার্ল, দেখল হার্ভে জরিপ করছে উঠটা। আধো-অন্ধকারে অ্যাংকর ফোরম্যানের ক্ষুদ্রকায় অবয়বটা দেখে ওর মনে পড়ল গোলাঘরে মাটির নীচে কী পোঁতা রয়েছে। সেদিন প্রায় ঘণ্টাখানেক উন্মত্তের মত ওখানে মাটি খুঁড়েছিল হার্ভে, কোমর-সমান গভীর একটা গর্ত খুঁড়তে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছিল সে, গাল বকছিল অনবরত। পরে গর্তটা আবার বুজিয়ে ভালমত মাটি দুরমুজ করে হার্ভে, তারপর প্রচুর কেরোসিন ছিটিয়ে দেয় সেখানে যাতে কোন অস্বাভাবিক গন্ধ না বেরোয় ছালায় পুরে যে জিনিস, ওখানে মাটিচাপা দেয়া হয়েছে খোলা হাওয়ায় বেশিক্ষণ ফেলে রাখলে একশো গজ দূর থেকেও তার দুর্গন্ধে পরিবেশ বিষিয়ে উঠবে।
পোর্টে ফিরে এল ফ্রেড হালাম, রূঢ় গলায় বলল, পাশের দরজায় যাও। বাড়ির কোনা ঘুরে অদৃশ্য হলো হার্ভে আর ক্যানাডা। অ্যাংকরের অফিস-ঘর ওইদিকে অবস্থিত।
কার্ল দিশেহারা হয়ে ভাবতে থাকে কী করবে সে-বাবার অনুকম্পা চাইবে, না পালিয়ে যাবে। বাবার সামনে দাঁড়াবার কথা মনে হতেই সাহস হারিয়ে ফেলল ও, জানে কোনদিনই তা সম্ভবপর হবে না ওর পক্ষে। কাজেই এখানে আর কোন আশা নেই, পালাতে হবে ওকে। ঘোড়ার পিঠে জিন চাপানো সম্ভব নয়, হার্ভে টের পেয়ে ওকে পাকড়াও করবে এও সত্যি, বাকি রাতটুকু আজ জেগেই কাটাকে হার্ভে, শহর থেকে ওর ফেরার অপেক্ষায় থাকবে। এর বাইরে যেতে চাইল না ওর চিন্তাশক্তি, ওর ভবিষ্যৎ বিচার করতে অস্বীকার করল তার কি আইনের হাতে ধরা দেয়া উচিত কার্লোস আর ডিউক কোথায় গেছে একবার জানতে পারলে হত।
পা টিপে টিপে নিজের ঘরে ঢুকল কার্ল, বুট পরল, পালাবার আকুতিতে হাত কাঁপছে। সরু কোমরে পিস্তলসমেত গানবেল্ট জড়াল সে, অন্ধকারে হাতড়ে টুপি খুঁজে নিয়ে মাথায় চাপাল। ড্রয়ার থেকে ওর টাকার বাকফিনের থলেটা বের করল, এখন আর মাত্র শ-দুয়েক ডলার রয়েছে ওতে। এবার ব্যারান্দায় বেরিয়ে এসে রেইল টপকাল কার্ল, নিচু হয়ে লাফ দিল। মাটিতে পড়ে ভারসাম্য হারাল সে, হুমড়ি খেল, হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গেল হিচ রেইলে বাঁধা, ক্যানাডার ঘোড়ার দিকে লাগাম খুলে ও যখন অপরিচিত স্যাডলে লাফিয়ে চড়ে বসল, ভয় পেয়ে হেষারব করল জানোয়ারটা। পরমুহূর্তে হার্ভের সচকিত চিৎকার পৌঁছাল ওর কানে।