আরেকটু এগিয়ে এসে ছোকরা এবার প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিল; গ্রীন যেখানে লুকিয়ে আছে, ওর চোখ পাহাড়ের সেই অংশে ঘোরাফেরা করছে। হালকা হয়ে ঘোড়াগুলো দেখতে গেল ও। তারপর মুহূর্তের জন্য অদৃশ্য হলো বাসার পেছনে, ফিরে এল একটা গামলা হাতে, ঝরনায় যাচ্ছে।
ছোকরাকে পানি আনতে বার কয়েক আসা-যাওয়া করতে হবে, ভাবল গ্রীন। পিছিয়ে খাজের নীচে চলে গেল ও, ঘোরাপথে ঢাল ধরে এগোল। যা ভেবেছিল তার চেয়ে বেশি সময় লাগল এতে, ও যখন ঝরনার ধারে পৌঁছাল তখন ছেলেটা এসে আবার চলে গেছে। উইলো ঝাড়ের ফাঁক দিয়ে সন্তর্পণে উঁকি দিল সে, লক্ষ করল বাসায় ফিরে যাচ্ছে ও, পানিভর্তি গামলাটা টলমল করছে ওর দুই হাতে।
গোড়ালিতে ভর রেখে বসল গ্রীন। ঝরনাস্রোতটা ইঞ্চি দুয়েকের বেশি গভীর নয় দেখে বুঝতে পারল কেন ছেলেটা ঘোড়াগুলোকে পানি খাওয়াতে এখানে আনেনি। ও যেখানে বসে আছে, আর দশ-বারো কদম ওপাশে ভেজা বালুর বুকে ছোঁকরীর বুটের ছাপ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সে। প্রথমে ওকে কাবু করে তারপর বাসার ভেতরে যে আছে তার ওপর চড়াও হওয়াই সুবিধেজনক হবে, ভাবল ও। এতে করে অনেক সোজা হয়ে যাবে কাজ, জানতে পারবে তার তদন্ত কোন্ পর্যায়ে রয়েছে।
গ্রীনের এই চিন্তা তার অভিজ্ঞতার ফসল, যুক্তিসঙ্গত; জীবনে বহুবার এরকম চিন্তাভাবনা করেছে সে। কিছুক্ষণ আগে যেমন অনিশ্চয়তার মাঝে ছিল, পরিস্থিতি এখন তার চেয়ে ভাল, অনেকটাই তার আয়রে মাঝে এসে গেছে। এবার সে নিজের পছন্দমত পরিকল্পনা করতে পারবে, অন্যের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করতে হবে না। নিঃশব্দে, অপেক্ষা করছে ও! এ সময় ওকে দেখলে মনে হবে যেন ধৈর্যের প্রতিমূর্তি। চওড়া শরীর, তবে কোথাও বাড়তি মেদ নেই। লম্বা, কিন্তু ঢ্যাঙা একে বলা যাবে না। বয়সের ছাপ বলতে, কপালের কাছে সামান্য পাক ধরেছে চলে।
উবু হয়ে আঁজলাভরে টলটলে ঠাণ্ডা পানি তুলে নিয়ে ঘষে মুখ পরিষ্কার করল সে, দুদিনের দাড়ির জঙ্গলে খসখসে শব্দ হলো। ভাল করে কুলি করল, ঘাড় ফেরাল থুতু ফেলতে। আবার যখন তাকাল গ্রীন তখন দেখতে পেল ছেলেটা ঝরনার কাছাকাছি চলে এসেছে, আস্তে হাঁটছে, মিনিট কুড়ি আগে গ্রীনকে প্রথম যেখানে দেখা গিয়েছিল সেই খাঁজটা জরিপ করছে ওর চোখ।
হঠাৎ থমকে দাঁড়াল ছেলেটা, ঘুরে পালাবার জন্য টানটান হয়ে গেল পায়ের পাতার ওপর, যেন সন্দেহজনক কোন শব্দ ধরা পড়েছে ওর কানে। খাজের দিকে তাকাল গ্রীন, কিন্তু উজ্জ্বল সূর্যালোকে ক্ষণিকের তরে ধাধিয়ে গেল ওর চোখ। তারপর। দেখল একটা মনুষ্যমূর্তি বেরিয়ে এসেছে বোল্ডারের আড়াল থেকে, পরক্ষণে রাইফেলধারী ক্যানাডাকে চিনতে পেরে ওর বিস্ময় ক্রোধে রূপান্তরিত হলো।
ছেলেটাও দেখতে পেয়েছিল ক্যানাডাকে, ওর যে প্রতিক্রিয়া হলো তা কোন নিরীহ ভবঘুরের কাছে প্রত্যাশা করা যায় না। ঝট করে গামলাটা হাত থেকে ফেলে দিল সে, ঝেড়ে দৌড় দিল বাসার উদ্দেশে, চেঁচাচ্ছে, ডিউক! সাবধান! কে যেন আসছে!
লাফিয়ে ঝরনাটা পার হলো গ্রীন, চোখের কোণে লক্ষ্য করল ক্যানাডা কাঁধের নিষ্পত্তি কাছে রাইফেল তুলছে। গুলি কর না! চিৎকার করে বলল ও।
কিন্তু ক্যানাডা ট্রিগার টিপে দিল। ওর চিৎকার ছাপিয়ে শোনা গেল রাইফেলের গর্জন, প্রতিধ্বনিত হলো পাহাড়ে-পর্বতে। বুলেটের আঘাতে কোমরের কাছে বাকা হয়ে গেল ছোঁকর কৃশকায় শরীর, ধুলোয় লুটিয়ে পড়ল। হাঁটুতে ভর দিয়ে উঠে বসল ও, টলতে টলতে সোজা হচ্ছে এমন সময় আরেকটা গুলি হলো। এবার লাটিমের মত একপাক ঘুরে গেল ছেলেটা, সটান আছাড় খেল চিত হয়ে। অসাড় দেহটাকে দৌড়ে পাশ কাটাল গ্রীন, রাগে জ্বলছে ওর ব্রহ্মতালু, ভাবছে এর চেয়ে জঘন্য কাজ আর কিছুই হতে পারে না। বাসার দিকে ছুটে গেল ও, কারবাইনটা ফেলে দিয়ে পিস্তল বের করল হেলস্টার থেকে। প্রথমে জানালা, তারপর দরজা লক্ষ্য করে গুলি করল দুবার। গরাদবিহীন জানালা দিয়ে ঘরের ভেতর ঝাপিয়ে পড়ল গ্রীন, দেখল পায়জামা পরিহিত হাড্ডিসার এক যুবক একটা বাংকের পাশে গুটিসুটি মেরে বসে আছে, হাতে রাইফেল। গুলি করল ছেলেটা, তাড়াহুড়োয় নিশানা নড়ে গেল, বদ্ধ ঘরে বিকট শোনাল রাইফেলের আওয়াজ। চকিতে পালটা জবাব দিল গ্রীন, প্রতিপক্ষের মাথার আধইঞ্চি ওপর দিয়ে উড়ে গেল বুলেট। তপ্ত সীসার ছ্যাকায় ভয়ে কুঁকড়ে গেল। ছেলেটা, চোখের পাতা ফেলল। ওকে হত্যা করা গ্রীনের ইচ্ছে নয়, জ্যান্ত ধরতে পারলে তদন্তের সুবিধা হবে, অপ্রত্যাশিত সুযোগটাকে তক্ষুণি কাজে লাগল সে। লাফিয়ে আগে বাড়ল ও, রাইফেলটা ছিনিয়ে নিল হাত থেকে, ছুঁড়ে ফেলে দিল ঘরের এককোণে।
শুরুতে হকচকিয়ে গেল অপরজন, তারপর আক্রমণ করল গ্রীনকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল দেয়ালের ওপর। এমনিতেই যথেষ্ট শক্তি ধরে যুবক, তার ওপর ভয় ওকে মরিয়া করে তুলেছে। এলোপাতাড়ি ঘুসি হাঁকাল সে, গ্রীনের পিস্তল ধরা হাত লক্ষ্য করে ঝাঁপ দিল।
বাংকের তলায় অস্ত্রটা ছুঁড়ে দিল গ্রীন, জানে আপাতত ওটার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। মাথা নিচু করল ও, এক কদম আগে বেড়ে সেঁটে গেল ছোরার গায়ের সাথে, ঝটকা মেরে ওর হাত দুটো সরিয়ে দিল দূরে, হাঁটু দিয়ে সজোরে আঘাত করল তলপেটে ব্যথায় ককিয়ে উঠল ছোকরা, পিছিয়ে গিয়ে দুহাতে চেপে ধরল পেট, হুমড়ি খেয়ে পড়ল দুরমুজ করা মেঝেতে ছটফট করছে যন্ত্রণায়, গোঙাচ্ছে।