সন্দেহজনক ব্যাপার। ভুরু কুঁচকে, স্যালুনে ঢুকল গ্রীন। দোরগোড়ায় থেমে চারপাশে নজর বোলাল। একপাশে বিধ্বস্তপ্রায় পুরানো একটা বার। ঘুরে ওটার পেছনে চলে গেল এক লোক, হাঁটার সময় ঈষৎ খোড়াচ্ছে। প্রতি পদে মেঝেতে শব্দ তুলছে ওর ছড়িটা। শেষপ্রান্তের দেয়ালে কয়েকটা তাক। কিছু টিনজাত খাবার, আলু, পেঁয়াজ, শালগম আর মটরশুটি রাখা। বারটেন্ডার ইতিমধ্যে তার দেহের ত্র রেখেছে একটা উঁচু টুলে; নধর দেহ, পরনে নোংরা কাপড়চোপড়, মাথাভর্তি পাকা বাবরি চুলের জট। মুখের চামড়া ঝুলে পড়েছে, স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে লাল লাল শিরাগুলো। ভারি লাঠি-সদৃশ ছড়িটা বারের ওপর রাখল সে, পোড় খাওয়া দৃষ্টিতে জরিপ করল গ্রীনকে।
হুইস্কি?
মার্থা ঝাঁকাল গ্রীন, লক্ষ করল কাউন্টারের নীচ থেকে বোতল আর গ্লাস বের করছে অপরজন। হাত বাড়িয়ে ওগুলো কাছে টেনে নিল সে, গ্লাসে ঢেলে পান করল নির্জলা হুইস্কি, কটু ঝাঁঝে জিভ পুড়ে যেতে মুখ বিকৃত করল। তুমি ভার্জিল, রীড? জিজ্ঞেস করল গ্রীন।
ওই নামটাই ব্যবহার করছি আমি।
কাল রাতে লাইল ক্যানাডা এসেছিল?
ঝুলকালি মাখা জানালাটার দিকে রীড তার তিক্ত দৃষ্টি ফেরাল কবরের মত নীরব ছিল ক্যাম্পটা। তারপর তুমি এলে, একজন অচেনা লোক, আমার কাছে মনে হলো আবার যেন সেইসব দিনের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। অহরহ লোক আসছে যাচ্ছে, চোখের নিমেষে ভেঙে ফেলছে দালানকোঠা। জনাকীর্ণ রাস্তায় বন্ধুদের গাল দিচ্ছে মানুষ। যখন তখন গুলি হচ্ছে, কিন্তু কেউ আমল দিচ্ছে না তাতে। চিৎকার, হৈ-হুল্লোড়, তারপর মাতাল মানুষগুলো ঢলে পড়ছে বেশ্যার কোলে।
বারের ওপর সজোরে ছড়িটা কয়েকবার আছড়াল রীড। তখনকার দিনে কেউ কাউকে চিনত না, কিন্তু সেজন্য প্রশ্ন করত না কোন। সবকিছুই ছিল জ্যান্ত, আমিও। তারপর একটি শ্যাফটে পড়ে গিয়ে পা ভেঙে ফেললাম আমি, খোড়া হয়ে গেলাম জীবনের মত।
ছড়িটা তুলল ও, আবার আছড়াল বারে। দেহের ভর বদল করল গ্রীন, অস্বস্তি বোধ করছে। উদ্ভট আচরণ লোকটার, লুকোচুরি খেলছে। বাধ্য হয়ে এবার সরাসরি বলল ও, আমি কার্ল হালামকে খুঁজছি। ওকে দেখেছ?
হালামের কাজ কর তুমি?
না। তবে আইন ছেলেটাকে খুঁজছে। ধরিয়ে দিতে পারলে ইনাম আছে। তুমি বরং ছড়িয়ে দাও খবরটা কারও কিছু জানা থাকলে, তাকে বলবে অকটিওতে মার্শাল মকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে।
মুখ দিয়ে অবজ্ঞার ঢঙে বিজাতীয় একটা শব্দ করল রীড, তারপর বিরাট ঘরটার পেছনের অংশে অবস্থিত সিঁড়ির দিকে চোখ পড়তে ফিক করে হেসে ফেলল আচমকা, দুই সারি কালো কালো ভাঙা দাঁত বেরিয়ে পড়ল। কয়েক জোড়া বুটের শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল সিঁড়িতে; একটু বাদে একজন তোক আবির্ভূত হলো, ঠিক পেছনেই আরেকজন।
গ্রীন লক্ষ্য করল প্রথমজন সেই থ্যাবড়া চোয়ালের লোকটা, কিছুক্ষণ আগে। দোতলার একটা জানালা থেকে একগাল হাসি উপহার দিয়েছিল ওকে। দ্বিতীয়জনের মুখটা লালচে, তাগড়া শরীর, চলাফেরায় হামবড়াই ভাব রয়েছে। দুজনেই নিরস্ত্র, খেয়াল করল সে।
ওদের উদ্দেশে ঘুরল রড, চেহারায় উত্তেজনার ছাপ। তোমরা মদ খাচ্ছিলে? জিজ্ঞেস করল।
হাচের কথা জানি না, তবে আমি দুঢোক খেয়েছি, জবাব দিল থ্যাবড়া-চোয়াল, হাসি দুকান ছুঁয়েছে। আমার এই বন্ধুকে দাও এক পেগ, গ্রীনের দিকে থুতনি ঝাঁকিয়ে যোগ করল।
সন্দিগ্ধ হয়ে উঠল গ্রীনের মন, বলল, থাক, লাগবে না, ধন্যবাদ। আরও ঘনীভূত হলো ওর সন্দেহ যখন লাল-মুখ হাচ বলল যাত্রার ঢঙে, আমাদের চেহারা ওর পছন্দ হচ্ছে, ফ্লিন্ট। জাহান্নামে যাক শালা।
আমারও পছন্দ হয়নি ওকে, সে কথাই যদি বল, আচমকা বিদ্বেষে হিসহিস করে উঠল ফ্লিটের গলা। দেখলেই মনে হয় কোন বেয়াড়া শেরিফ।
গ্রীন অনুভূব করল সে ফাঁদে পড়েছে, এবং ব্যাপারটা পুরোপুরি সাজানো। ফ্লিন্টের চোখে কুমতলবের আভাস পেল ও, নিরুপায় ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, ঠিক আছে, খাচ্ছি।
না, খাবে না–আপত্তি জানাল ফ্লিন্ট। কিন্তু গ্রীন ততক্ষণে ভরে ফেলেছে ওর গ্লাস। ওটা উঁচু করল সে, আবার কাঁধ ঝাঁকাল, তারপর ভেতরের তরল পদার্থটুকু ছুঁড়ে দিল ফ্রিন্টের চোখে-মুখে।
চমকে উঠল ফ্লিন্ট, পিছিয়ে গেল। হাচ খিস্তি করল, ক্ষিপ্তভাবে লাফ দিল গ্রীনের দিকে। চকিতে একপাশে সরে গেল শ্ৰীন, মদের বোতল দিয়ে বাড়ি মারল হাচের মাথায়। বেমক্কা আঘাতে টলে উঠল দুবৃত্ত, ভাঁজ হয়ে গেল হাঁটু।
ব্যান্ডানা দিয়ে চোখ মুছে পিটপিট করে গ্রীনের দিকে তাকাল দীর্ঘদেহী, ফ্লিন্ট, রাগে হাত আর কাঁধের পেশীগুলো ফুলে উঠেছে। বারে পিঠ ঠেকিয়ে ওদের পরবর্তী হামলার অপেক্ষায় রইল গ্রীন। টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল হাচ, এক হাতে চেপে ধরে আছে মাথা। খুকখুক করে কাশল ও, থুতু ফেলল, কুদ্ধ ভঙ্গিতে বুকে চাপড় মেরে বলল, ধোলাই খাওয়ার শখ হয়েছে মনে হয়।
দাঁত কেলিয়ে হাসল ফ্লিন্ট, তেড়ে এল। আচমকা পেছন থেকে হাত বাড়াল ভার্জিল রীড; গ্রীন কিছু বুঝে ওঠার আগেই শক্ত বেষ্টনীতে পেঁচিয়ে ধরল ওর গলা। এইবার! চিৎকার করল রীড, দুহাত আঁকড়ে ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বাঁকা করে ফেলেছে গ্রীনের ঘাড়, কজির হাড় ক্রমশ চেপে বসছে থুতনির নীচে।
বারের ওপর ধনুকের মত বাঁকা হয়ে আছে গ্রীনের পিঠ, অনুভব করছে ওর উক্ত পেটে দমাদম ঘুসি মারছে ফ্লিন্ট। এরপর হাচ যোগ দিল ফ্লিন্টের সঙ্গে, দুজনে মিলে অনবরত আঘাত করতে লাগল ওর শরীর আর মুখে। চোয়াল চেপে নরকযন্ত্রণা সহ্য করল গ্রীন, চোখে সর্ষের ফুল দেখছে। পায়ের পাতায় ভর দিয়ে কোমর সামান্য উঁচু করল ও, হাত উঠিয়ে চেপে ধরল রীডের দুই কব্জি। শুনতে পেল খিস্তি করছে রীড, বলছে, তাড়াতাড়ি কর! বেশিক্ষণ এভাবে ধরে রাখতে পারব না আমি। শালার শরীরে ষাড়ের শক্তি।