- বইয়ের নামঃ নিষ্পত্তি
- লেখকের নামঃ রওশন জামিল
- সিরিজঃ ওয়েস্টার্ন সিরিজ
- প্রকাশনাঃ সেবা প্রকাশনী বই
- বিভাগসমূহঃ ওয়েস্টার্ন, রোমাঞ্চকর গল্প
নিষ্পত্তি
০১.
সূর্য ওঠার ঘন্টাখানেক আগে মরুভূমিতে এসে পড়ল ওরা। চারদিকে ফণীমনসার ঝাড় আঁর অসংখ্য বেলেপাথরের টিবি ছড়ানো ছিটানো। থোকা থোকা অন্ধকার জমে রয়েছে ফাঁকে-ফোকরে। তারই ছায়ায় এগিয়ে চলেছে দুই ঘোড়াসওয়ার। সতর্ক, কারণ এই গোলকধাঁধায় পথ হারাবার ভয় প্রতি পদে।
ঝড়ের বেগে চিন্তা করছে জেমস গ্রীন। যেখানে যাচ্ছে সেখানে পৌঁছাতে আর কতক্ষণ লাগবে ওদের? সকাল হবার আগেই ও গন্তব্যে উপস্থিত হতে চায়, পলাতক আসামীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার সেরা সময় ওটা, তখন তন্দ্রাচ্ছন্ন থাকে, শরীর আড়ষ্ট হয়ে থাকে।
নিঝুম ভোরে কোথাও কোনও শব্দ নেই। কেবল অবিশ্রাম ঘোড়ার খুরের ভোতা আওয়াজ আর স্যাডল লেদারের খসখস। অকস্মাৎ খাড়া একটা ঢালের গোড়ায় পৌঁছে রাশ টেনে মাটিতে নামল লাইল ক্যানাডা। যোৎ করে নাক ঝাড়ল ওর বুটিদার সোরেল, হেষাব করল। গলা খাকারি দিল কানাডা, গুতু ফেলল। তারপর জামার আস্তিনে শ্মশ্রুমণ্ডিত মুখ মুছে হাসল গ্রীনের দিকে তাকিয়ে।
বাপস! এসেছি শেষপর্যন্ত, খনখনে গলায় বলল সে। বলেছিলাম পারব, এখন হয়েছে বিশ্বাস? হাতের ইশারায় পাথরাইভরা, খাড়াইটা দেখাল ক্যানাডা। এই খাজের ওপাশে কেবিন, ছোকরাগুলো ওখানেই লুকিয়ে থাকে। ঝরনাও আছে একটা, ঠিক যেমনটা বলেছি তোমাকে। গার্সিয়া পরিবার আগে এখানে ভেড়া চরাত, বুড়ো পটল তোলার পর ছেলেপুলেরা শহরে উঠে গেছে। মাথা দুলিয়ে খিকখিক করে হাসল ও, স্যাডলবুটে রাখা রাইফেলের উদ্দেশে হাত বাড়াল। যাই, দেখে আসি গিয়ে ওরা আছে কিনা।
ফিকে আলোয় ঢালটা জরিপ করছিল গ্রীন। বলল, তুমি এখানেই থাকবে।
অসম্ভব! আমি তোমাকে পথ দেখিয়ে এনেছি, আনিনি? টাওসেই বলেছি একসময় এই সীমান্তে কাজ করেছি আমি, কাজেই এখানকার সবকিছু আমার–
চেঁচাবেনা, বাধা দিল গ্রীন, চোখ পাকিয়ে তাকাল সঙ্গীর পানে। গলা নামাও। বুট থেকে নিজের কারবাইনটা তুলে নিল সে, পরখ করে স্যাড ছাড়ল।
তা হলে আমরা দুজনেই যাব, বেজার মুখে বলল ক্যানাডা। ওদেরকে ওখানে না পেলে অকটিওতে গিয়ে মার্শাল মককে জানান ব্যাপারটা।
আমাকে পথ দেখিয়েছ তুমি, ব্যস, এন বিরক্ত। তোমার দায়িত্ব শেষ।
বললেই হলো! ওই তিন ছোকরাই হয়তো আছে ওখানে, ওদের–
লম্বা একটা শ্বাস টানল গ্রীন, ওর ভরাট বুকের ছাতি ফুলে উঠল। থাকতে পারে। কিন্তু তাতে প্রমাণ হয় না ডাকাতিটা ওরাই করেছে, আমার কাজ সেটা তদন্ত করা।
ক্যানাডা ইতিমধ্যে রাইফেল বের করেছে বুট থেকে। রাগের পাশাপাশি প্রচ্ছন্ন ধূর্ততা প্রকাশ গেল ওর কণ্ঠে। একাই পুরস্কারের টাকাগুলো তুমি হাতিয়ে নেয়ার তাল করছ না নিশ্চয়?
আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়াল গ্রীন, মুখ থমথমে, চোখ দুটো সংকুচিত, নিষ্ঠুর। এখনও তুমি বেঁচে আছ কীভাবে সেটাই আশ্চর্য, নরম গলায় বলল ও। যাকগে, চুপচাপ এখানে থেকে ঘোড়াগুলো পাহারা দাও।
ইতস্তত-বিক্ষিপ্ত পাখরাইয়ের মাঝ দিয়ে, কোনাকুনিভাবে ছোট ছোট পা ফেলে দ্রুত ওপরে উঠতে শুরু করল গ্রীন। মেজাজ তেতো হয়ে গেছে, ঝগড়া করছে নিজের সঙ্গে। হামবাগ। লোকটাকে দেখেই তোমার বোঝা উচিত ছিল কেমন চিজ। মস্ত বোকামি করেছে ওকে সাথে এনে। একটু চেষ্টা করলে ওর সাহায্য ছাড়াই এ জায়গা খুঁজে বের করতে পারতে তুমি।
এই দায়িত্বটা নেয়া তার উচিত হয়নি, কথাটা আবারও ভাবল ও। পুরো ব্যাপারটা কেমন যেন খাপছাড়া। শুরু থেকেই খুঁতখুঁত করছে ওর মন। ক্যানাডার সঙ্গে দুই দিন দুই রাত কাটাবার পরেও তার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের কোনও কারণ সে খুঁজে পায়নি। যাক, আজকের পর আর ওই লোককে প্রয়োজন হবে না তার। অন্তত কিছুটা স্বস্তি পাওয়া যাবে এর ফলে।
দীর্ঘ দুরারোহ খাড়াই, খাজের মাথায় উঠে হাঁপাতে লাগল গ্রীন। ঘামছে দরদর করে, ব্যথা করছে ভর পেশীগুলো। একটা বোল্ডারে ঠেস দিয়ে বুকভরে শ্বাস টানল ও আকাশ ধূসর হয়ে এসেছে লক্ষ্য করে বুকে হেঁটে এগোল, কিনার থেকে আলগোছে উঁকি দিয়ে দেখল নীচের অবতল জমিটা।
প্রথমে ছোট্ট জরাজীর্ণ একটা বাড়ি চোখে পড়ল ওর। রোদে পোড়া ইটের তৈরি বড়সড় জানালা রয়েছে একটা গরাদবিহীন; দরজাটা ওর মুখোমুখি বন্ধ। একপাশে খড়ের চালাঘর, দুটো ঘোড়া বাধা আছে। বাসা থেকে শ-খানেক গজ দূরে, পাহাড়ের গোড়ায়, ঝরনা-প্রচুর ঘাস আর উইলো ঝাড়ে ঘেরা।
আবার ঘোড়া দুটোর দিকে তাকাল গ্রীন, ভাবছে তিনটে থাকা উচিত ছিল। তারপর আপনমনে কাঁধ ঝাঁকাল। ঘোড়াগুলো দুজন ভবঘুরের হওয়া বিচিত্র না, কাছেপিঠে পানি আছে দেখে পরিত্যক্ত বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। ব্যাপারটা আসলে কী, সেটা জানাই ওর কাজ।
সবে নামতে শুরু করেছে ও এই সময় আচমকা ভোরের আলো ফুটে উঠল, দূরের পাহাড়-পর্বতে ছড়িয়ে পড়ল নবারুণের উষ্ণ গোলাপি আভা! চট করে একটা পাথরচাঁইয়ের আড়ালে আত্মগোপন করল গ্রীন। ধেত্তোরি, বলল বিড়বিড় করে। মরুভূমিতে কত দ্রুত সকাল হয় ভুলে গিয়েছিল সে।
বেকায়দায় পড়ে গেছে ও, এখন সরাসরি বাড়িতে ঢুকে পড়তে হবে। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে, ওখানে যারা আছে ঘুমন্ত অবস্থায়ই পাকড়াও করতে পাবে তাদের। তারপর বাসার পেছন দিকে দৃষ্টি গেল ওর, চুলোর চিমনি থেকে ধোঁয়া উঠতে দেখল। গ্রীন অনুভব করছে তার এখন খাঁজের ওপাশে, আগের জায়গায় ফিরে যাওয়া উচিত। একটু বাদে ক্যাচ শব্দে খুলে গেল নীচের দরজাটা, বুট আর জিন্স পরনে একহারা গড়নের এক যুবক পা রাখল বাইরে, হাই তুলল! লম্বা কালো চুল নেমে এসেছে ঘাড় অবধি, মুখমণ্ডল বাদামি, গাল তোবড়ানো। মেক্সিক্যান, প্রথম দর্শনেই বুঝতে পারল গ্রীন। অনুমান করুল ও-ই বোধহয় গার্সিয়াদের ছেলে, কার্লোস।