ফেলিপ জাপাটার প্রতি যত বিদ্বেষ বা প্রতিহিংসাই থাকুক, আপাতত বর্তমান কয়েকটা সমস্যার সমাধান করতে হবে। ঘোড়া, একটা ওয়্যাগন, এবং অপরিহার্য সাপ্লাই দরকার, ট্রিপটা চালিয়ে যেতে হবে। করুণ হাল আমাদের ছোট্ট পালের। কিন্তু ওটাকেও বড়সড় করে তোলা সম্ভব। দুটো কমবয়েসী বঁড় আর বিশটার মত গাভী রয়েছে, বেশিরভাগই অল্পবয়সী। অন্যগুলো বলদ, নগদ লাভের একমাত্র উপায়-এমনকি এ মুহূর্তে এদের মূল্য কম হলেও।
ম্যাগোফিন্সভিলের কিছু কিছু লোক শহরটাকে ফ্রাঙ্কলিন বলে। অন্যরা নাম দিয়েছে এল পাসো ডেল নার্ট, অর্থাৎ এল পাসোর উত্তর অংশ, যেটা আমেরিকার সীমানায় পড়েছে। তবে বেশিরভাগ লোকই আলাদা আলাদা নামে তিন শহরকে আখ্যায়িত করছে।
জেমস উইলি ম্যাগোফিনের সেলুনের সামনের হিচিং রেইলে ঘোড়া বেঁধে ভেতরে ঢুকলাম। স্যাম গার্ট আর কার্ল ক্ৰকেট রয়েছে আমার সঙ্গে।
ম্যাগোফিন কেন্টাকির লোক, প্রায় তেরো-চোদ্দ বছর আগে এখানে এসেছিল, বাড়ি তৈরি করার পর স্টোর আর ওয়্যারহাউস খাড়া করে ব্যবসা শুরু করে।
দীর্ঘ কামরা পেরিয়ে যাওয়ার সময় নিজের বাহ্যিক উপস্থিতি সম্পর্কে ভাবলাম-সমীহ করার মত বিশেষ কিছু নেই আমার মধ্যে। কোমাঞ্চেরোদের হামলার সময় রেজর হারিয়েছি, তাই কয়েকদিন ক্ষৌরি করা হয়নি। কালো জীর্ণ হ্যাট চাপানো মাথায়, ক্রাউনের কাছাকাছি একটা বুলেটের ফুটো রয়েছে। রঙ ঝলসে যাওয়া মলিন বাকস্কিন শার্ট পরনে। ঝালর দেয়া শটগান চ্যাপস রয়েছে গায়ে। স্পানিশ বুটের চেহারা ভোতা হয়ে এসেছে। গোড়ালি ক্ষয়ে গেছে ওগুলোর। গার্ট আর ক্রকেটকে আমার চেয়ে ধোপদুরস্ত এবং সমীহকরার মত দেখাচ্ছে।
মি, ম্যাগোফিন, বললাম আমি। কোমাঞ্চেরোরা আমার গরুর পাল নিয়ে গেছে। আমরা টি-বার আউটফিট, কাউ-হাউস থেকে পশ্চিমে এসেছি। এখান থেকে উত্তর-পশ্চিমের রেঞ্জ বসতি করব। এ মুহূর্তে করুণ দশা সবার। মেয়ে আর বাচ্চারা ঘোড়ায় চেপে এসেছে, পুরুষরা পায়ে হেঁটে এসেছি আমরা।
চিন্তিত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল সে। কি চাও তুমি?
দশ-বারোটা ঘোড়া, একটা ওয়্যাগন এবং সতেরোজন লোকের দুই সপ্তাহের রসদ।
স্থির দৃষ্টিতে আমাকে দেখছে সে, ক্ষণিকের জন্যে কার্ল আর স্যামের ওপর ঘুরে গেল তার দৃষ্টি। মহিলাদের কথা বললে না?
হ্যাঁ। আমার দু’জন লোকের স্ত্রী, একজনের বিধবা বউ। পাঁচটা বাচ্চা আর একটা মেয়ে। নিউ মেক্সিকো থেকে এসেছে ও।
ওর নামটা জানতে পারি?
জুয়ানিতা ম্যাকনেয়ার।
আমার কাঁধের ওপর দিয়ে দরজার দিকে তাকাল সে। আচমকা টের পেলাম ঘাড়ের পেছনে দাঁড়িয়ে গেছে আমার সবক’টা চুল। ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ালাম, দরজায় ফেলিপ জাপাটাকে দেখতে পেলাম। লোকটার পেছনে আরও তিনজন কোমাঞ্চেরো রয়েছে।
অজান্তে মুঠি হয়ে গেল হাত, জাপাটা কাছে আসা মাত্র ঘুসি হাঁকালাম।
এমন কিছু আশা করেনি সে। হয়তো ভেবেছে তর্কাতর্কি হবে প্রথমে, তারপর ডুয়েল বা গোলাগুলি হবে। টেক্সাস বা নিউ মেক্সিকোর লোকেরা হাতাহাতি তেমন পছন্দ করে না। তখনকার দিনে দু’জন মানুষের মধ্যে দ্বন্দ্ব বা সংঘাতের নিস্পত্তি করার জন্যে পিস্তলকে ধরা হত সবচেয়ে ভদ্রোচিত উপায়, হাতাহাতি বা মুষ্টিযুদ্ধ ছিল বর্বরোচিত, অভদ্রলোক-সুলভ।
চিবুকে লাগল মোক্ষম ঘুসিটা। ছয় ফুট দুই ইঞ্চি লম্বা আমি, কয়েক আঙুল খাটো হব জাপাটার চেয়ে। জীবনের অর্ধেক সময় কেটেছে কুঠার চালিয়ে, ঘোড়া বলদ বা বুনো ঘোড়ার সঙ্গে কুস্তি লড়ে। কঠোর পরিশ্রমে সামর্থ্য বাড়িয়ে নিয়েছি। জাপাটা বিন্দুমাত্র টলল না, স্রেফ হুড়মুড় করে পড়ে গেল মেঝেয়।
অন্য কেউ কিছু করার আগেই, পিস্তলে তিন কোমাঞ্চেররাকে কাভার করল কার্ল, পিছিয়ে যেতে বাধ্য করল ওদের।
ঝুঁকে জাপাটার শার্ট খামচে ধরে টেনে তুললাম তাকে, পায়ের ওপর দাঁড় করালাম। তারপর জোরাল ঘুসি হাঁকালাম বিশালদেহী মেক্সিকানের পেটে। ঘুসির ধাক্কায় টলে উঠল সে, পা হড়কে পিছিয়ে গেল, কাউন্টারের সঙ্গে পিঠ ঠেকিয়ে পতন রোধ করল। পাল্টা ঘুসি চালাল সে এবার, কিন্তু মাথা নিচু করে ঘুসিটা এড়িয়ে গেলাম; উল্টো প্রচণ্ড ঘুসি বসিয়ে দিলাম ওর সোলার প্লেক্সাস বরাবর। সামলে নেয়ার সুযোগ দিলাম না ওকে, প্রচণ্ড হুক ঝাড়লাম লোকটার চিবুকে।
উন্মত্ত আক্রোশ নিয়ে, মরিয়া হয়ে লড়াই করল সে, বুঝে গেছে মরণপণ না লড়লে কপালে খারাবি আছে আজ, এবং একা লড়তে হবে-সঙ্গীরা সাহায্য করতে পারবে না। দারুণ শক্তিশালী মানুষ, বিশাল দেহ ওর জন্যে বাড়তি একটা অস্ত্র। মুগুরের মত হাতে জোরও আছে বেশ। কিন্তু দিনটা আমার। শীতল উন্মাদনায় রূপ পেয়েছে আমার সমস্ত রাগ আর প্রতিহিংসা। জাপাটার একটা আঘাতও গ্রাহ্য করছি না। আমাকে ফেলে দিল ও…দু’বার বোধহয়।
উঠে দাঁড়িয়ে, পা ছড়িয়ে দাঁড়ালাম, তারপর ঘুরতে শুরু করলাম। ঘুসি মেরেই সরে এলাম ওর নাগাল থেকে। এমন বেশ কয়েকবার ঘটল। মারের চোটে পিছিয়ে গেল সে ঘুসি মেরে দরজা দিয়ে বাইরের রাস্তায় ফেলে দিলাম ওকে, পিছু নিয়ে আমিও বেরিয়ে এলাম। নাক-মুখ থেঁতলে দিলাম দুই ঘুসিতে, দুই মুঠি একসঙ্গে চালালাম ওর চিবুকে।
পাল্টা আঘাত করছে সে, কিন্তু কিছুই অনুভব করছি না আমি। ওকে মেরে থেঁতলে বানানো ছাড়া অন্য কোন চিন্তা নেই মাথায়। এক ঘুসিতে থ্যাবড়া হয়ে গেল জাপাটার নাক, আরেক ঘুসিতে ঠোঁট ফেটে গেল। ভুরু কেটে গেছে ওর, রক্ত পড়ছে গলগল করে, কিন্তু, থামলাম না আমি। পথিবীতে কাউকে যদি ঘৃণা করে থাকি, তাহলে এই লোকটিকে। এত সহজে ওকে ছেড়ে দেয়ার ইচ্ছে নেই আমার। হিচিং রেইলের সঙ্গে ঠেসে ধরে একের পর এক ঘুসি হাঁকালাম ওর মুখে।