রোজিটা জেপসন, যে-ঘোড়ায় চড়েছে, চিনতে পারলাম। ইন্ডিয়ান পনি। এটার মালিকের ওপর চড়াও হয়েছিল কার্ল ক্ৰকেট। কার্লের কাছ থেকে পরে জেনেছি ছুটতে ছুটতে অনেকদূর, চলে গিয়েছিল সে, ইন্ডিয়ানকে কায়দা করে ফিরে আসার সময় তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়, এবং ততক্ষণে লড়াই শেষ হয়ে গিয়েছিল।
এলাকায় কোমাঞ্চি আর কোমাঞ্চেররাদের আধিপত্য, তাই নদীর কিনারে একটা খাদে আশ্রয় নেয় সে, ঘোড়া সহ লুকিয়ে পড়ে। পুরো রাত ভিজে কাটিয়েছে, সকালে দেখতে পায় কিছু গরু দক্ষিণে চলে যাচ্ছে। ওগুলোকে জড়ো করতে গিয়ে জেপসনদের দেখা পেয়ে যায়।
জুয়ারেজ ছিল ওদের সঙ্গে। অবস্থা বেশ খারাপ ছিল তার। ইন্ডিয়ানরা বন্দী করেছিল ওকে, কিন্তু দুই কোমাঞ্চিকে খুন করে পালিয়ে আসে জুয়ারেজ। তবে আবার জখম হয়েছে। ক্ষতগুলো গুরুতর না হলেও গত কয়েকদিনে মোটামুটি সেরে উঠেছে।
একসঙ্গে গরু জড়ো করেছে ওরা, তারপর দক্ষিণ-পুবে ড্রাইভ করেছে, মিগুয়েলের পরিচিত এক লাইমস্টোনের বেসিনে যাওয়ার উদ্দেশে। ওখানে পানি ছিল। কিছু লিপানের সঙ্গে দেখা হয়েছে ওদের, একটা বলদের বিনিময়ে লিপানদের কাছ থেকে কর্ন আর বীজ কিনেছে।
প্রায় বিশ মাইল পশ্চিমে আসার পর জিম মুরের দেখা পায় ওরা। খোড়া ঘোড়ার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল সে..নদীর কিনারে আশ্রয় নিয়েছিল, সওয়ারহীন একটা ঘোড়া ধরে বৃষ্টির পর পশ্চিমে রওনা দেয়। ওর ধারণা ছিল ক্যাম্পের সবাই মারা পড়েছে।
নয়দিন পর এল পাসোয় পৌঁছলাম আমরা। ছোট্ট শহর। একতলা একটা অ্যাডোবি দালান, নদীর মেক্সিকান অংশে অবস্থান ওটার। উত্তর অংশে বেশ কিছু বসতি রয়েছে, সবচেয়ে বড়টা কুন র্যাঞ্চো এবং ম্যাগোফিন্সভিল, দুটোর মধ্যে দেড় মাইল তফাত। তৃতীয় আরেকটা বসতি রয়েছে, ম্যাগাফিন্সভিল থেকে এক মাইল দূরের এক র্যাঞ্চ।
শহরের কাছাকাছি করালে সব গরু জড়ো করেছি আমরা-ডোরাকাটা বলদটাই নেতৃত্ব দিয়েছে। কাছাকাছি চলনসই একটা আশ্রয়ও খুঁজে নিয়েছি আমরা।
ড্যান, এবার কি করব আমরা? জানতে চাইল কার্ল।
যা করার কথা ছিল, উত্তরে বললাম। অন্তত আমি তাই করব। এগিয়ে যাব। একটা আউটফিট দাঁড় করাব। যে-কটা গরু আছে তা নিয়েই র্যাঞ্চ শুরু করব।
তারপর?
তারপর? শিকারে-বেরোব। মুখে মাকড়সার মত একটা ক্ষত আছে এক লোকের, ওর নাম ফেলিপ জাপাটা, ওই লোকের খোঁজে বেরোব।
মনে মনে পরিস্থিত বিচার করলাম। সঙ্গে যারা আছে, বাবা বা আমার অধীনে কাজ করার জন্যে এসেছে সবাই। আমাদের ওপর বিশ্বাস আর আস্থা রেখেছে ওরা। ওদের কাউকে নিরাশ করা যাবে না, যেভাবেই হোক সফল হতে হবে। অথচ আমাদের সবার কাছে যে টাকা আছে সব মিলিয়ে হয়তো বড়জোর পঞ্চাশ ডলার হবে, গুটিকয়েক গরু ছাড়া সবই হারিয়েছি। এগোতে হলে ঘোড়া, গিয়ার আর বিভিন্ন ধরনের সাপ্লাই প্রয়োজন।
সামনে মাইলকে মাইল অ্যাপাচী এলাকা, এবং যেখানে আমরা বসতি করব, সম্ভবত সেই জায়গাটাও অ্যাপাচী এলাকায় পড়েছে। জাপাটা বা ওর লোকজনের ওপর শীতল অসন্তোষ আর বিষ্ণা ক্রমে রাগ এবং ঘৃণায় রূপ পাচ্ছে। জিনিসটাকে সত্যি ভয় পাই আমি।
আমার ভেতরে অদ্ভুত একটা প্রবণতা রয়েছে। এমনিতে আমি মিতভাষী, গম্ভীর চেহারার আত্মকেন্দ্রিক মানুষ, সকাল-সন্ধ্যা গাধার মত খাটতে পারি এবং মানুষের সঙ্গ উপভোগ করি, অথচ এসবের আড়ালে অদ্ভুত আর ভয়ঙ্কর একটা স্পৃহা আছে যেটাকে সত্যিই ভয় পাই আমি। অদম্য এই স্পৃহাকে প্রায়ই দমন করতে হয়, কারণ বিপজ্জনক বা ভয়ঙ্কর লোক হিসেবে নাম কেনার ইচ্ছে নেই আমার-এটা অতি উৎসাহী সব তরুণের জানা উচিত, পরিপকৃত আসেনি এমন বয়স্ক লোকদেরও জানা থাকা উচিত। কিন্তু তারপরও, এটা ঠিকই বাস করে আমার মধ্যে, খুব কম লোকেরই ভয়ঙ্কর এই রাগ দেখার সৌভাগ্য হয়েছে।
বাবা জানতেন-স্যান এন্টোনিয়োতে আমার সঙ্গে ছিলেন তিনি; কার্লও জানে, কারণ লারেডোর ঘটনা সেও দেখেছে।
এবং এখন, ক্রমে ভয়ঙ্কর রূপ নিচ্ছে ওটা, রাগ বাড়ছে আমার। উন্মত্ত আক্রোশ অনুভব করছি। বাবা মারা গেছেন, স্বাভাবিক মৃত্যু তা বলা যাবে না। বাবা ছাড়াও কয়েকজন ভালমানুষ খুন হয়েছে। ব্র্যান্ডের জন্যে রাইড করত এরা, বিশ্বস্ততা আর আন্তরিকতার কারণে অকালে ঝরে গেছে কয়েকটা প্রাণ।
মনের গভীরে প্রচণ্ড আক্রোশের অস্তিত্ব টের পাচ্ছি, ক্রমে বাড়ছে সেটা। এই অনুভূতি অচেনা নয়। বাড়তে বাড়তে এমন একটা মুহূর্ত আসবে যখন ঠাণ্ডা মাথায় কিছুই ভাবতে পারব না আমি-যা করা উচিত, শুধু এ ব্যাপারটাই থাকবে মাথায়। সামান্য ভয়ও থাকবে না তখন, শত্রুকে খুঁজে বের করার নিরন্তর তাগাদা ছাড়া অন্য কিছু থাকে না মনে, কোন কারণ, ঘটনা বা পরিবেশই গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় না।
অনুভূতিগুলো তীক্ষ্ণ হয়ে আসে, হৃৎস্পন্দন হয়ে পড়ে শ্লথ, ধীর গতিতে শ্বাস নিই, সতর্ক পায়ে এগোনোর সময় চারপাশে সতর্ক চালাই। এমন সময়ে চরম নিষ্ঠুর হয়ে পড়ি আমি, অদম্য এবং দুর্জয় হয়ে উঠি।
এই অবস্থা কখনোই পছন্দ নয় আমার।
শুধু এ কারণেই পিস্তল ঝোলাই না আমি। বেশ কয়েকবারই, স্রেফ পিস্তল ছিল না বলেই বুনো রাগ আর আক্রোশকে চেপে রাখতে পেরেছি-যা করার ইচ্ছে হয়েছিল, পিস্তল না থাকায় করতে পারিনি। দু’বার সীমাহীন এই আক্রোশ চালনা করেছে আমাকে, প্রতিবারই সারা সত্তায় প্রবল আলোড়ন অনুভব করেছি, শপথ করেছি এই ঘটনা যেন আর না ঘটে।