সকালে আবার যাত্রা করলাম আমরা। গুয়াডালুপের চূড়াগুলোকে যে-কোন সময়ের চেয়ে উঁচু মনে হচ্ছে এখন, উত্তরের প্রেয়ারিকে দেখাচ্ছে অবারিত গাঢ় রঙের এক বিস্তৃত প্রান্তর। সেদিন দুবার পড়ে গেল টিম অটম্যান। আমাদের মধ্যে ওই বয়স্ক। প্রতিবারই ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল সে, তারপর হাঁটতে শুরু করল আবার।
মাত্র কয়েক মাইল পর সেদিন ক্যাম্প করলাম আমরা। ওক আর পাইনের আড়ালে এক চিলতে জায়গা, পেছনে পাহাড়ের চূড়া যেন হামলে পড়েছে আমাদের ওপর।
ঝপ করে মাটিতে বসে পড়ল টিম অটম্যান, ক্লান্তির চরমে পৌঁছে গেছে। মিলল আর স্যাম মেয়েদের নামতে সাহায্য করল, তারপর ঘোড়ার স্যাডল-ব্রিডল খুলে যত্ন নিল। ক্যাম্প করার আগেই প্যাটার্সন হাতে শিকার করতে বেরিয়ে পড়লাম আমি।
ভেতরে ভেতরে সত্যিই শঙ্কিত হয়ে পড়েছি। পুরো একটা দিন খাবার ছাড়া কেটেছে পুরুষদের, গত চার-পাঁচদিন যাও বা মুখে দিয়েছি প্রয়োজনের তুলনায় তা নিতান্তই কম ছিল। টিম আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বয়স্ক, প্রায় সারাটা জীবনই স্যাডলে কেটেছে ওর। অথচ কুপার মাইন এখনও বহুদূরের পথ।
জেদ, মনোবল বা স্বপ্নও এখন আর ওদেরকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে যথেষ্ট নয়। যদি খাবার যোগাড় না করতে পারি, হয়তো বেশিদূর এগোতে পারব না আমরা।
কয়েকবার হরিণের লাদি চোখে পড়ল, কিন্তু সবই অনেকদিন আগের। হরিণ দূরে থাক, ট্রাকও চোখে পড়েনি। জাপাচী এলাকা বলেই, নিশ্চিত না হয়ে গুলি ছোড়ার ইচ্ছে নেই আমার।
শান্ত বিকেল। ঘাম জমেছে কপালে, শার্টের ভেতর বুকে গড়িয়ে পেটের দিকে নেমে যাচ্ছে, ঘামের ধারা। আকাশ সুনীল, মেঘ নেই কোথাও। অদ্ভুত কোন কারণে টানটান হয়ে আছে স্নায়ুগুলো। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছি না, দেখতে যাচ্ছি না। তাই সতর্কতার সঙ্গে এগোলাম।
দূরে আকাশের গায়ে অলস ভাবে চক্কর মারছে একটা বাজার্ড। ক্ষীণ ট্রেইল ধরে প্রায় হাজার খানেক ফুট উঁচু উপত্যকায় উঠে এলাম, নিচের ক্যাম্প আড়ালে পড়ে গেছে। শার্টের আস্তিনে হাতের তালু মুছে এগোলাম। হঠাৎ পঞ্চাশ গজ দূরে ক্লিফের কিনারে একটা বিগহর্ন ভেড়া চোখে পড়ল।
ভেড়াটা বেশ বড়সড়, ক্লিফের নিচে মনোযোগ ওটার। সামনের দিকে ঝুঁকে আছে লম্বা শিং, হরিণের মতই গায়ের রঙ ওটার, পশমগুলোও তাই। এটাই আমার দেখা প্রথম বিগহর্ন।
প্যাটার্সন তুলে সতকর্তার সঙ্গে নিশানা করলাম, ঠিক ওটার ঘাড়ের পেছনে-একটু নিচে। মেরুদণ্ডে গুলি বেঁধানোর ইচ্ছে, যাতে ঠিক যেখানে আছে সেখানেই ধরাশায়ী হয়। হৃৎপিণ্ডে গুলি করলেও ভেঁড়াটা ছুটে যেতে পারে কয়েকশো গজ, হয়তো পাহাড়ের আড়ালে হারিয়ে যাবে। হরিণের ক্ষেত্রে সচরাচর এটাই ঘটে, হৃৎপিণ্ডে গুলি লাগার পরও আধ-মাইল ছুটে যেতে সক্ষম ওরা। বিগহর্নটা হয়তো আরও বেশিদূর চলে যাবে। সামনে জমি হলে সমস্যা ছিল না, কিন্তু এটা পাহাড়ী এলাকা। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বোল্ডারের কোন্ ফাঁকে গিয়ে লুকাবে, শেষে হয়তো খুঁজেই পাব না।
নিশানা স্থির করেছি, কিন্তু বিগহর্নের ধীর-স্থির শান্ত মূর্তি আর মনোযোগ বেখাপ্পা লাগছে। রাইফেল নামিয়ে সন্তর্পণে কয়েক পা এগোলাম, ক্লিফের ধারে পৌঁছে নিচের জমির দিকে তাকালাম।
প্রথমে একটা গরু চোখে পড়ল…সাদা-মুখো লংহর্ন। ওটার পেছনে আরও দুটো বেরিয়ে এল। আমাদের গরু এগুলো। তারপর ঝোঁপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল এক লোক।
জিম মুর!
দাঁড়িয়ে থেকে, গরুর পেছন পেছন মুরকে ড্র থেকে পাহাড়ের কিনারে বেরিয়ে আসতে দেখতে পেলাম। অন্তত ত্রিশটা বলদ রয়েছে ওখানে, তাছাড়া কয়েকটা গাভী, কিছু বাছুর বা বয়স্ক ষাড়ও আছে। পেছনে দুজন মানুষ এবং একমাত্র ঘোড়ার স্যাডলে একজন মহিলা।
চিৎকার করতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিয়ে বিগহর্নটার দিকে তাকালাম। খানিক পিছিয়ে গেছে ওটা, পাশ ফিরেছে, উপত্যকা থেকে নেমে যাবে। দ্রুত রাইফেল তুলে নিশানা করেই ট্রিগার টেনে দিলাম।
শূন্যে উঠে গেল ভেড়াটা। পা ছড়িয়ে আছড়ে পড়ল মাটির ওপর। ঝট করে উঠে দাঁড়াল ওটা, খিচে দৌড় দেবে মনে করে আবারও নিশানা করলাম। কিন্তু হাঁটু ভেঙে পড়ে গেল মোষটা, গড়ান খেল শরীর, তারপর একেবারে স্থির হয়ে গেল।
নিচের বেসিনে তাকিয়ে কাউকে চোখে পড়ল না। গরুগুলো দাঁড়িয়ে আছে, ক্লিফের দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে আছে, নাকের পাটা ফুলে উঠেছে। স্মিত হেসে রাইফেল নামালাম আমি, তারপর নিচু স্বরে ডাকলাম। জানি বিকেলের নিস্তরঙ্গ বাতাসে কারও কণ্ঠ অনেকদূর থেকে শোনা যাবে।
ভয় পেয়েছ নাকি তোমরা? আরে, বেরিয়ে এসো, গরম পাথরে পা রাখার দরকার নেই!
ড্যান? ড্যান ট্রেভেন? কার্ল ক্রকেটের কণ্ঠ।
যদি তা না হয়, পাল্টা চিৎকার করলাম আমি। শুধু শুধু এত বছর আমাকে খাইয়ে বড় করেননি বাবা!
খোলা জায়গায় বেরিয়ে এল ওরা। ঘোড়ার স্যাডলে বসে আছে রোজিটা জেপসন, পুরুষরা কার্ল ক্ৰকেট, জিম মুর এবং জুয়ারেজ। তারপর ঝোঁপের আড়াল থেকে আরও একজন বেরিয়ে এল-টুম জেপসন!
আনন্দে চিৎকার করলাম আমি, ছুটে নামতে গিয়ে ভেড়াটার কথা মনে পড়ল।
জিম! জলদি এখানে চলে এসো! একটা বিগহর্ন শিকার করেছি!
ঢাল বেয়ে উঠে এল সে। তুমি আসলে আমার চেয়েও বড় কসাই, ড্যান। ঝটপট খালাস করে ফেলো এটাকে, ওস্তাদ। এই ফাঁকে অন্যদের সঙ্গে কথা বলে আসি। ফিরে এসে সাহায্য করব তোমাকে।