টানা বৃষ্টি হচ্ছে, ওয়্যাগনের ক্যানভাসে বৃষ্টির ভোতা কিন্তু জোরাল শব্দ ছাপিয়ে আগুয়ান কারও পদশব্দ শুনতে পেলাম, একটু পর মিসেস অটম্যান আর টিম উঠে পড়ল ওয়্যাগনে।
মাথা চেপে ধরে উঠে বসল স্যাম, চারপাশে তাকাল শূন্য দৃষ্টিতে।
এবার বোধহয় বাতি জ্বালানো যেতে পারে, বললাম আমি। চলে গেছে ওরা, নইলে দেয়াশলাই জ্বালানোর পর আমার লাশ ফেলে দিত।
মোমবাতি জ্বেলে বাড়তি কার্তুজের খোঁজে ওয়্যাগনে তল্লাশি চালালাম।
এই যে, তোমার রাইফেল, প্যাটার্সনটা এগিয়ে দিল টিম অটম্যান। আসার পথে খুঁজে পেয়েছি।
শার্পসটা ওর হাতে ধরিয়ে দিলাম। প্যাটার্সটা মুছে, কার্তুজ বের করে তাজা বুলেট ঢোকালাম।
শুধু কি আমরাই বেঁচে আছি? প্রায় বিলাপের সুরে জানতে চাইল মিসেস অটম্যান। অন্যদের খবর জানো?
বাবা মারা গেছেন। স্কয়ার বেচারা স্ট্যাম্পিড ঠেকাতে গিয়ে পিষ্ট হয়েছে খুরের নিচে। বেন টিল্টনকে পড়ে থাকতে দেখেছি।
জিম মুর নদীর পাড় ধরে নেমে গিয়েছিল। নদীতে ডুবে মারা গিয়ে থাকলে নিশ্চয়ই বেঁচে আছে ও।
ওয়্যাগনে গাদাগাদি অবস্থায় বসে সকালের অপেক্ষায় থাকলাম আমরা। লাগাতার বৃষ্টি হচ্ছে। আর যাই হোক, পানির কোন ঘাটতি হবে না এখন। একটা গরু খুঁজে জবাই করতে হবে, নিরুদ্দিষ্ট একটা খুঁজে পেতেই হবে। আর যেভাবেই হোক রিও গ্রান্ড বা কপার মাইন পর্যন্ত পৌঁছতে হবে আমাদের।
খাবার নেই, এটাই দুশ্চিন্তার সবচেয়ে বড় কারণ। অন্য ওয়্যাগনে খাবার ছিল। আগুনে নষ্ট না হলেও বৃষ্টিতে নিশ্চই নষ্ট হয়ে গেছে এখন। যদিও আমার প্রত্যাশা হয়তো কিছু খাবার পাব, তবে পরিমাণ নিতান্ত অল্প।
ঘোড়া নেই আমাদের, গরুর পালের সঙ্গে ওগুলোও পালিয়েছে। হয় চুরি হয়েছে, নয়তো ছড়িয়ে পড়েছে। ওগুলোর দু’একটাকে যে ধরতে পারব এমন সম্ভাবনা কম। সামনে কেবলই অনিশ্চয়তা, দুর্ভোগ আর কষ্টকর মৃত্যুর হাতছানি। এরচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি কেউ কল্পনাও করতে পারে না; অথচ সঙ্গে মহিলা আছে আমাদের।
পুরো দায়িত্বই আমার। এরা আমাদের লোক, আমাদের হয়ে কাজ করেছে; বাবা মারা যাওয়ায় স্বভাবতই পুরো দায়িতু এখন আমার। এ অবস্থায়, সব গরু হারানোর পরও দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারি না আমি। এখন বরং যে-কোন সময়ের চেয়ে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দরকার, অনিশ্চয়তায় ভরা এই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পেতে হবে-খাবার আর ঘোড়া যোগাড় করতে হবে; এবং একটা আশ্রয় খুঁজে পেতে হবে।
ভেতরে ভেতরে গভীর শঙ্কা বোধ করছি, যেহেতু এমন ভয়াবহ এবং অসহায় পরিস্থিতিতে কখনও পড়িনি। মন জুড়ে ব্যর্থতার আশঙ্কা, আর ব্যর্থতা মানেই নিশ্চিত মৃত্যু…সবাই না হলেও আমাদের মধ্যে যারা দুর্বল, তাদের জন্যে।
সারারাত ধরে বৃষ্টি হলো। পেকোসের দু’কুল ছাপিয়ে উঠেছে, কাছাকাছি সব অ্যারোয়োও ভরে গেছে। পশ্চিমে যাওয়ার পথে একাধিক বাধা তৈরি হয়ে গেছে। তবে সূর্য ওঠার পর অনেক অ্যারোয়ো শুকিয়ে যাবে, বালিময় তীর পানি শুষে নেবে। শুধু প্রাকৃতিক কিছু টিনাজায় পানি থাকবে।
মেঘের কম্বল মুড়ি দেওয়া ধূসর গম্ভীর আকাশের পেছন থেকে উদিত হলো সূর্য। বৃষ্টি ধরে এসেছে কিছুটা, কাছাকাছি, বজ্রপাত হচ্ছে না এখন। দূরে গুয়াডালুপে পর্বতশ্রেণীর আনাচে-কানাচে প্রতিধ্বনি তুলছে বজ্রপাতের গম্ভীর শব্দ।
আড়ষ্ট ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালাম, তারপর মাটিতে পা রাখলাম। গায়ে স্লিকার চাপিয়ে চারপাশে সতর্ক দৃষ্টি চালালাম।
ভেজা মাটি গাঢ় রঙ ধারণ করেছে, পুরো ক্যাম্প কর্দমাক্ত হয়ে আছে। আকাশে ভারী মেঘের আনাগোনা। ভরা যৌবন ফিরে পেয়েছে পেকোস-গাঢ় রঙের পানিতে স্রোত উঠেছে। বাবার শরীর তুলে নিয়ে ওয়্যাগনের কাছে ফিরে এলাম, ওয়্যাগনের তলায় রেখে চারপাশ খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করলাম।
ক্যাম্পের কিনারে বাড সাইক্লীফের লাশ পড়ে আছে। নদীর তীরে পড়ে আছে আরেকটা লাশ-অপরিচিত লোক কোমাঞ্চেরোদের একজন। বেন টিল্টনের লাশ তুলে নিয়ে এসে বাবার পাশে রাখলাম।
যে-কোন কিছু করার আগে ঘোড়া দরকার আমাদের, কিন্তু দৃষ্টিসীমায় চোখে পড়ল না। মরা একটা ঘোড়া পড়ে আছে কাছাকাছি। এগিয়ে গিয়ে ওটার পিঠ থেকে স্যাডল ছাড়িয়ে নিলাম, ব্রিডল খুলে ওয়্যাগনে এনে রাখলাম।
ওয়্যাগন থেকে নেমে এসেছে টিম অটম্যান। তুমি আর মিসেস অটম্যান সাহায্য করতে পারো, ওকে বললাম, ওয়্যাগন খুঁজে দেখো খাবার কিছু পাওয়া যায় কিনা। ক্যান্টিন, বেড়িং, অস্ত্র বা কার্তুজ, যাই পাবে সংগ্রহ করো।
নড করল সে, বিষণ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল চারপাশে। আমাদের শেষ করে দিয়েছে ওরা, ড্যান। একেবারে ফকির বানিয়ে দিয়েছে।
অত হতাশ হয়ো না। প্রথমে কপার মাইনে যাব আমরা, তারপর দেখব কি করা যায়। বাবার কাগজপত্র, টালি-বুক বা ওরকম কিছু খুঁজে পেলে আমার জন্যে আলাদা করে রেখো।
স্যাম গার্টও নেমে এসেছে। অসুস্থ এবং ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে ওকে, কিন্তু স্মিত কৌতুকের হাসি উপহার দিল আমাকে। মনে হচ্ছে দীর্ঘ পথ হাঁটতে হবে আমাদের। পারবে তো, ড্যান?
চারপাশে খোঁজ চালালাম আমরা। জিম মুরের পাত্তা নেই, হয় ডুবে গেছে নয়তো নদীর স্রোত ভাসিয়ে নিয়ে গেছে তাকে।
একটা ব্যাপার সচেতন ভাবে এড়িয়ে যাচ্ছি আমরা, বাচ্চাদের প্রসঙ্গ তুলছি না কেউ। টিমের দুই ছেলে এবং বুচার্ডের বাচ্চারা। ক্যাম্পে হামলার পর এদের কাউকে দেখেনি কেউ, কিন্তু রাতে পাহারা দেয়ার জন্যে জেগে ওঠার পর ওদেরকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখেছি আমি।