ক্যাম্পের আলোয় দুলছে ওয়্যাগনের ছায়া। মিসেস অটম্যান এসে যোগ দিল আমাদের সঙ্গে। জুয়ানিতার সোনালী চুলে আগুনের ছোপ লেগেছে, মাথা নাড়তে ঝিকিয়ে উঠল মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে থাকলাম, বারবার চোখ চলে যাচ্ছে ওর দিকে…আহ, এত সুন্দর ও!
রোজিটা জেপসনও এসেছে, স্বামীর পাশে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসেছে ও; তবে একটা কথাও বলেনি। একেবারে নীরব হয়ে, আছে মহিলা। ট্যাপের সঙ্গে তিক্ত ওই ঘটনা প্রায় সবাই ভুলে গেছে, রোজিটাকে কেউই তিরস্কার বা ভৎর্সনা করেনি, কারণ আমাদের চেয়ে আর বেশি কে জানবে যে মানুষের মন আসলে সবচেয়ে দুর্বল এবং স্পর্শকাতর জায়গা?
বাবাও আছেন আমাদের মধ্যে, চুপচাপ শুনছেন সবার গল্প। মুখ দেখে মনে হচ্ছে বয়স কয়েক বছর কমে গেছে। নতুন একটা জায়গা খুঁজে নেব আমরা, এক ফাঁকে বললেন তিনি। বসতি করব। টি-বারকে নিয়ে যেন গর্ব করতে পারি, এমন আউটফিট তৈরি করব আমরা।
প্রায় সবার মধ্যে নতুন ভাবে আশা জেগে উঠছে, স্বপ্ন দেখছে সবাই; কিন্তু একইসঙ্গে শঙ্কিতও। আমরা জানি, অনিশ্চিত ভাগ্য, ভবিষ্যৎ বা শত দুর্ভোগের পরও, কোমাঞ্চি আর কোমাঞ্চেরোদের হামলার হুমকি খড়গের মত ঝুলে আছে মাথার ওপর। যে-কোন সময় আক্রমণ করতে পারে ওরা।
উঠে দাড়ালাম আমি, জুয়ানিতার দিকে তাকাতে দেখলাম সেও উঠে দাঁড়িয়েছে। হেঁটে আমার পাশে চলে এল ও, আগুনের কাছ থেকে সরে এলাম আমরা। ওয়্যাগনের পাশে দাঁড়িয়ে আছে জুয়ারেজ, ওর পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় তিনটা শব্দে শুভেচ্ছা জানাল সে; ‘ভায়া কন ডিয়োস’।
ফ্রিম্যান স্কয়ার ঘুম থেকে জাগাল আমাকে। ঝটপট উঠে বসে মাথায় হ্যাট চাপালাম। সবুকিছু শান্ত…আকাশে তারা নেই, মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়েছে চাঁদ, ভারী বাতাসে সোঁদা গন্ধ। গায়ে বুট গলিয়ে পিস্তল দুটো তুলে নিলাম। গানবেল্ট কোমরে জড়িয়ে অন্যটা বেল্টের পেছনে গুঁজে রাখলাম।
রাইফেলের দিকে হাত বাড়ালাম, তখনই পাহাড়ের কাছে তীক্ষ্ণ শব্দ শুনতে পেলাম। সেকেন্ড কয়েক পর তীক্ষ্ণ চিৎকার কানে এল-বুনো উন্মাদনায় যুদ্ধ ঘোষণা করল একদল কোমাঞ্চি। ছুটন্ত ঘোড়া রাতের নিস্তব্ধতা কাঁপিয়ে ছুটে আসছে ক্যাম্পের দিকে।
মুহূর্তের মধ্যে আতঙ্কিত হয়ে পড়ল গরুর পাল-ছুটতে শুরু করল। স্ট্যাম্পিড ঠেকাতে মরিয়া হয়ে গরুর দিকে ছুটে গেল ফ্রিম্যান স্কয়ার, কিন্তু হোঁচট খেল ঘোড়াটা। মাটিতে ভূপতিত হলো সে। উন্মত্ত গরুর দল ছুটে গেল ওর ওপর দিয়ে।
ফ্রিম্যানের জন্যে দুঃখ করে লাভ নেই। চট করে এক হাঁটু গেড়ে বসলাম আমি, গুলি শুরু করলাম।
ক্যাম্পে ঢুকে পড়া এক কোমাঞ্চিকে গুলি করলাম প্রথমে, স্যাড়ল থেকে খসে পড়ল সে। চোখের কোণ দিয়ে দেখতে পেলাম গড়ান দিয়ে বিছানা থেকে সরে গেলেন রাবা, শটগানের ট্রিগার টিপলেন!
মুহূর্তের মধ্যে মুখর হয়ে উঠল জায়গাটা-পিস্তল আর রাইফেল গর্জে উঠছে, কমলা আগুন ওগরে দিচ্ছে, রক্তলাল ঝলক ছুটে যাচ্ছে রাতের অন্ধকার ভেদ করে!
ওয়াগনের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল কার্ল ক্ৰকেট, সমানে গুলি করছে সিক্সশূটার থেকে। ঘোড়া ছুটিয়ে ওকে পিষে ফেলার চেষ্টা করল এক ইন্ডিয়ান। কিন্তু সুবিধে করতে পাল্প না। ঝট করে ঘুরে দাঁড়িয়ে কোমাঞ্চিকে খামচে ধরল সে, তারপর এক লাফে ইন্ডিয়ানের পেছনে, পনির পিঠে চেপে বসল। অন্ধকারে ছুটে গেল ঘোড়াটা, পিঠে দুই সওয়ার নিজেদের মধ্যে লড়াই করতে দারুণ ব্যস্ত।
ধূসর ঘোড়ায় বিশালদেহী এক লোক ছুটে গেল পাশ দিয়ে-সঙ্গে সঙ্গে লোকটাকে চিনতে পারলাম। ব্লন্ড চুল লোকটার। ওয়েব হর্নারের সঙ্গে ছিল সে।
কোত্থেকে ছুটে এসে আমার কাঁধে ধাক্কা মারল একটা ঘোড়া, তৎক্ষণাৎ ভূপতিত হলাম, মুখের সামনে ধুলো চটকাল একটা বুলেট।
গড়ান দিয়ে উঠে বসলাম আমি। দেখলাম হাঁটু গেড়ে বসে গুলি করছেন বাবা। মুখে রক্ত লেগে আছে ওঁর, কিন্তু এত ধীর-স্থির ভাবে এবং ঠাণ্ডা মাথায় গুলি করছেন যেন শূটিং গ্যালারিতে অনুশীলন করছেন। মাটিতে হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে আছে বেন টিল্টন, দেখলাম হঠাৎ করেই উঠে বসে নতুন অবস্থানের দিকে খিচে দৌড় মারল জিম মুর, গুলির তুবড়ি ছুটছে ওর আশপাশ দিয়ে।
আচমকা বাড সাটক্লীফকে দেখতে পেলাম, ক্যাম্পে চার্জ করেছে সে,, বাবার উদ্দেশে গুলি করছে। হোলস্টার থেকে পিস্তল তুলে নেওয়ার সময় দেখলাম বুলেটের ধাক্কায় চিৎ হয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন বাবা। পরমুহূর্তে সাটক্লীফের বিশাল বুকের ছাতি ফুটো হয়ে গেল আমার গুলিতে। স্যাডল থেকে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ল সে, ঘোড়াটা তুফান বেগে ক্যাম্প পেরিয়ে গেল। গোড়ালির ওপর আধ-পাক ঘুরলাম আমি, উঠতে উদ্যত হওয়া সাইক্লীফের মাথায় নিশানা করলাম এবার, কোমরের কাছ থেকে করলাম গুলিটা। কাটা কলা গাছের মত দড়াম করে আছড়ে পড়ল সে, ধীর ভঙ্গিতে গড়ান খেয়ে চিৎ হলো শরীরটা।
যেমন আচমকা শুরু হয়েছিল, তেমনি শেষ হয়ে গেল লড়াই। অখণ্ড নীরবতা নেমে এল চারপাশে।
একটা ওয়াগনের ছাদে আগুন জ্বলছে, দেখেই পানি ভরা বালতি তুলে নিয়ে আগুনের দিকে ছুঁড়ে দিলাম। এক লাফে উঠে পড়লাম ওয়্যাগনে, জ্বলন্ত ক্যানভাসের কিনারা ধরে ফ্রেম থেকে টেনে ছিড়ে ফেললাম। পুরো ক্যানভাস খুলে আসার পর মাটিতে ফেলে ঠেসে ধরলাম, বুট দিয়ে মাড়ালাম। তীক্ষ্ণ শব্দে পাশ দিয়ে ছুটে গেল একটা সীসা, ওয়্যাগনের পাটাতনে বিঁধল। ঝটপট মাটিতে শুয়ে পড়লাম আমি, স্থির হয়ে পড়ে থাকলাম।