পেছনে একটা কবর ফেলে এসেছি আমরা, মনে করিয়ে দিলাম ওকে। এক মেক্সিকানকে পেয়ে গোর দিয়েছিলাম।
ফের হাসল জাপাটা। কৌশলটা মন্দ নয়…কিন্তু আমি সাবধানী মানুষ কিনা, তাই কবর খুঁড়ে দেখলাম। কারও লাশ ছিল না। ঘোড়া ঘুরিয়ে নিল সে, তারপর ধীর গতিতে ক্যাম্প ছেড়ে চলে গেল।
আমরা সবাই জানি, আবার আসবে সে। হয়তো শিগগিরই। তখন যে ঝামেলা হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
বেশ, এ নিয়ে ভেবে লাভ নেই, দ্রুত ঘোষণা করলাম। নাস্তা সেরে ঝটপট রওনা দেব।
রাতে বেশ কয়েকটা বলদ আর গাভী নদীর কাছে যেতে সক্ষম হয়েছে, পরে আবার ফিরেও এসেছে। ড্রাইভে মোট কত গরু খোয়া গেল গোনার উপায় নেই, ফুরসতও নেই এখন, তবে আন্দাজ করা যায় কয়েকশো গরু হবে।
এগোলাম আমরা। মোটামুটি একই গতিতে এগিয়ে চলেছি। দুপুরে পানি পান করার জন্যে পেকোসে থামলাম, পাহাড়শ্রেণীর লাগোয়া ট্রেইল ধরে সমান্তরালে এগোচ্ছি এখন। মাঝে মধ্যে পাহাড়ে উঠে গিয়ে চারপাশে নজর চালাচ্ছে ক্রুদের কেউ, শত্রুর উপস্থিতি আগেই টের পাওয়ার ইচ্ছে। কখনও কখনও পেছনে চলে গিয়েও অপেক্ষায় থাকলাম।
মাটি শুকনো খটখটে, বেশিরভাগ জায়গায় সাদা স্যালাইনের মত আবরণে ঢাকা-ক্ষারের অবশেষ। যেখানেই পানি ছিল, জমি বা মাটি সাদা হয়ে আছে, যেন তুষার জমেছে।
পিছিয়ে পড়ে আমার পাশে চলে এলেন বাবা। সংখ্যায় নিতান্তই কম আমরা, ড্যান, বললেন তিনি। পঞ্চাশ-ষাটজন লোক নিয়ে ফিরে আসবে ওরা।
জীবন্ত কোন কিছু চোখে পড়ছে না। এখানে-সেখানে মরা গরু পড়ে। আছে। শুকনো হাড় আর চামড়ার সংস্করণ, নেকড়ে বা অন্য কোন প্রাণী হামলা করেনি মৃত গরুর ওপর। এর মানে পরিষ্কার-এমনকি নেকড়েও এই এলাকায় থাকে না।
রাত হয়ে গেল, তখনও কোন ঘাস চোখে পড়েনি, তাই নিচু একটা টিলার কাছাকাছি ওয়্যাগনগুলো জড়ো করলাম আমরা, ঠিক পেছনেই রয়েছে সব গরু।
কাছাকাছি বনে প্রিকলি পিয়ার রয়েছে। গরুর জন্যে ঘাসের বিকল্প হতে পারে। জিনিসটা সঁাাতে ও ভেজা বলে পানির চাহিদা অনেকটা মিটে যাবে। প্রায় দশ-বারোজন বনের ভেতরে ঢুকে পড়লাম আমরা, প্রিকলি পিয়ারের কাটা ছেটে ফেললাম। মশাল জ্বেলে আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। কাঁটা না থাকায় সাগ্রহে প্রিকলি পিয়ার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল গরুর দল।
সকালে, বাতাসের সঙ্গে সঙ্গে ধুলোর মেঘ উঠল। মাথার ওপর পুরো আকাশ ভরে গেল, ধুলোর ঘূর্ণি ছুটে গেল জমিন ধরে। সূর্য যেন আগুনের বলয়, ধুলোর মেঘ ঢেকে ফেলেছে। পেছনে দমকা বাতাস নিয়ে এগিয়ে চলেছে গরুর পাল, পেকোসের প্রায় সমান্তরালে, তবে একেবারে কাছেও নয়, কারণ কাছে থাকলেই বাঁক আর উঁচু-নিচু পথ পাড়ি দিতে হবে।
রাতে ধুলো থিতিয়ে এল বটে, কিন্তু বাতাস অস্বাভাবিক ঠাণ্ডা মনে হলো। বড়সড় একটা টিলার পেছনে ওয়্যাগন থামিয়ে ক্যাম্প করলাম আমরা।
কার্ল ক্ৰকেট সবার সাথে আগুনের কাছে গিয়ে বসল। এমা বুচার্ডকে রান্নায় সাহায্য করছে। খাবার বলতে গেলে নেই তেমন, খোড়া কয়েকটা বলদ জবাই করেছি আমরা, কিছু মাংস শুকিয়ে রাখা হয়েছে। আটা প্রায় শেষ এবং গুড় নেই একটুও।
স্যাম গার্ট এসে যোগ দিল আমাদের সঙ্গে। ফর্সা মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি গড়িয়েছে ওর, বড়বড় বিষণ্ণ চোখে আমাদের নিরীখ করল। কলোরাডো যাওয়ার পথে ক্যানাড়া নদীর তীরে কাটানো একটা রাতের কথা মনে পড়ছে। এমন ধুলো ঝড়ে পড়েছিলাম যে সূর্যও দেখা যাচ্ছিল না। প্রেয়ারি কুকুরগুলো দূরে থাক, নিজেদেরকেও ঠিকমত দেখতে পাচ্ছিলাম না।
আগুনের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে হাত বাড়িয়ে দিলাম শিখার দিকে, খানিকটা উষ্ণতার আশায়, মনে মনে বেশ কয়েকটা ব্যাপারে ভাবছি। ট্যাপ চলে যাওয়ার পর বাবা পুরোপুরি আমার ওপর নির্ভর করছেন; কিন্তু এ পর্যন্ত নির্ভার হওয়ার মত কিছুই করতে পারিনি। এই গরুগুলোই আমাদের শেষ সম্বল, অথচ পালের অবস্থা মোটেও সুবিধের নয়। ফেলিপ জাপাটা আর কোমাঞ্চেলরদের সঙ্গে সম্ভাব্য একটা লড়াই রয়েছে হাতে, দেখা হওয়া মাত্র মরণপণ লড়াই করতে হবে, অথচ ওদের তুলনায় আমাদের লোকজন নিতান্তই অল্প।
ইতোমধ্যে কয়েকশো গরু হারিয়েছি আমরা। আর হারানো যাবে। জুয়ানিতা বা জুয়ারেজের কাছ থেকে যা শুনেছি, তাতে নিশ্চিত ভাবে বলা যায় যে-জায়গার জন্যে এই দুর্ভোগ, গন্তব্যে আমাদের জন্যে রয়েছে। অনিশ্চয়তা এবং বিপদের সম্ভাবনা। ভয়াবহ ঝামেলায় পড়ে যেতে পারি।
রসদপত্র প্রায় ফুরিয়ে গেছে, শিকার করারও সুযোগ নেই। বুনন পশু এখানে থাকলেও দূরে চলে গেছে কোন কারণে। শুধু একটা কাজই করার আছে আমাদের-গরু দলকে সামনে নিয়ে যাওয়া।
ঘোড়ার ব্যাপারে সন্তুষ্ট আমরা, প্রত্যাশার চেয়েও বেশি নৈপুণ্য দেখিয়েছে ওগুলো। হর্স হেড পর্যন্ত আসতে আসতেই বেশিরভাগ ঘোড়া মারা যায় নয়তো ইন্ডিয়ানরা চুরি করে নিয়ে যায়; কিন্তু এ পর্যন্ত তেমন কিছু ঘটেনি। বেশিরভাগ লোকের ড্রাইভের সঙ্গে পায়ে হাঁটার কথা, এখন স্যাডলে চড়ছি আমরা। এ মুহূর্তে, কেনল এগিয়ে যাওয়াই একমাত্র কাজ, কারণ দুনিয়ার সবচেয়ে কঠিন কাজটাও লেগে থাকলে সম্পন্ন করা যায়, কিন্তু আমার অনেকবারই মনে হয়েছে চলার মধ্যে থাকলে কখনও কখনও সমস্যার সমাধানও হয়ে যায়।