ধীর গতিতে এগিয়ে আসছে রাত আর অন্ধকার।
ক্রুদের অবস্থাও যে ভাল বলা যাবে না। চেহারায় ক্লান্তি, উদ্বেগ এবং অনিশ্চয়তার ছায়া। কোন রকমে স্যাডলে টিকে আছে এরা, রক্তলাল হয়ে গেছে চোখ। কিন্তু তারপরও অদ্ভুত এক স্বপ্নের আকর্ষণ তাদের টেনে নিয়ে চলেছে পশ্চিমে। গরুর চিৎকার নেই, মৃদু স্বরে যোৎ ঘোৎ করে সবসময়, এমনকি তাও করছে না এখন। পড়ন্ত বিকেলের নিস্তব্ধতায় এগিয়ে চলেছে ওরা।
একটা বাছুর পিছিয়ে পড়েছিল। ওটার পাশে চলে এলাম আমি, কয়েল করা দড়ি দিয়ে পাছায় আঘাত করলাম। বিন্দুমাত্র গ্রাহ্য করল না ওটা, ডান ঘোড়াটা ওটাকে মুখ দিয়ে ঠেলা দিতে নড়ার ইচ্ছে দেখা গেল ওটার মধ্যে, টলমল পায়ে এগোল।
অনেক গরু লুটিয়ে পড়েছে। দুবার পড়ে যাওয়া গরুর মুখে কয়েক ফোঁটা পানি দিলাম কান্টিন থেকে দুটোই উঠে দাঁড়াল। রাতের ঠাণ্ড বাতাসে একসময় কিছুটা হলেও শক্তি ফিরে পাবে ওরা, অনুসরণ করবে আমাদের, কারণ অন্য কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই।
হঠাৎ দমকা বাতাস বয়ে এল পাহাড়ের দিক থেকে, বাতাসে পানির সোঁদা গন্ধ!
যাদুর মত কাজ হলো। ঝট করে মাথা তুলল গরুর দল, দ্রুত এগোল, তারপর হালকা চালে ছুটতে শুরু করল। মিনিট কয়েক পর তুমুল বেগে ছুট লাগাল, রীতিমত স্ট্যাম্পিড় ঘটে গেল। পানির গন্ধ খেয়েছে ওরা, পানির কাছে কে কার আগে পৌঁছা’বে-তাই নিয়ে হিড়িক পড়ে গেছে। কয়েকটা পড়ে গেলেও পানির টানে ঠিক খাড়া হয়ে গেল এবং ছুটতে শুরু করল আবার।
ছুটন্ত খুরের শব্দ কাঁপিয়ে দিয়েছে প্রান্তরের নিস্তব্ধতাকে, যেন গুড়গুড় শব্দে মেঘ ডাকছে; তারপর হঠাৎ করে নীরবতা নেমে এল। ধুলোর উৎকট গন্ধ ট্রেইলে।
পেকোসের ধারে যখন পৌঁছলাম, ততক্ষণে আকাশে তারা ফুটেছে। আগুন জ্বালানো হয়েছে, ওয়াগনগুলো পৌঁছে গেছে।
ঘোড়াটার পা কাঁপছে থরথর করে। হেঁচড়ে স্যাডল ছাড়লাম, মিনিট খানেক ডানের গায়ের সঙ্গে গা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। তারপর ধীর ভঙ্গিতে স্যাডল-ব্রিডল খুলে দলাইমলাই করে দিলাম ওটাকে।
আগুনের কাছে এসে রিপোর্ট করল কার্ল। এক রাউন্ড পান করেছে ওরা। পানির কাছ থেকে সরিয়ে রেখেছি ওদের।
ভাল…সকালের আগে আর পানি দেয়া যাবে না, আগুনের কাছাকাছি বসে স্ক্যাবার্ড থেকে রাইফেল তুলে নিয়ে ওটা পরিষ্কার করতে শুরু করলাম। যাই ঘটুক, এটাকে ঝকঝকে কার্যকর অবস্থায় রাখা উচিত।
চারজন লোক পাহারায় থাকবে আজ, বললাম কালকে। একজন ক্যাম্প থেকে দূরে থাকবে; শুনবে, চারপাশে নজর রাখবে। এ পথে প্রায়ই যাতায়াত করে ইন্ডিয়ানরা।
আমার হাতে কফির কাপ ধরিয়ে দিল মিসেস বুচার্ড। গিলে ফেল, বয়, বলল মহিলা! এটা তোমার পাওনা, অর্জন করেছ।
কফি তো অবশ্যই, সঙ্গে খানিকটা আইরিশও মেশানো, চুমুক দিয়ে টের পেলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে চাঙা বোধ করলাম। রাইফেল পরিষ্কার করে, ওয়্যাগনে গিয়ে আমার ডাফ-ব্যাগটা বের করলাম। পিস্তল দুটো বের করে একটা হোলস্টারে ঝুলিয়ে দিলাম, অন্যটা ভেস্টের পেছনে কোমরে গুঁজে রাখলাম।
আগুনের কাছে এসে বাবাকে দেখতে পেলাম। চট করে আমার হোলস্টারের দিকে তাকালেন তিনি, কিন্তু কিছুই বললেন না।
অনেকক্ষণ ধরে আমাকে দেখছে টম জেপসন, শেষে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ল। জানতাম না হ্যান্ডগান চালাও তুমি। ঝামেলা, আশা করছ নাকি
তুমি ক্লান্ত, টম। আজ রাতে খানিকটা ঘুমিয়ে নাও। যাকগে, আমি চাই সব ব্যারেল ভরে ফেলবে তোমরা। এখনই।
এখন? ভুরু কুঁচকে তাকাল জেপসন। মাথা খারাপ হয়েছে নাকি তোমার? ক্লান্তির চরমে পৌঁছে গেছে সবাই। এ অবস্থায় তুমি ওদের পানি ভরার জন্যে বলতে…
পারি, এবং বলছি। কাজ শুরু করো, টম-ঘুমানোর আগে সব কটা ব্যারেল ভরবে।
সত্যি তাই করল ওরা।
প্রায় রাত একটার পর ঘুমাতে গেলাম আমি। ধীরে ধীরে শরীর শিথিল করে দিলাম, আড়ষ্ট মাংসপেশীর খিল ছাড়িয়ে, উদ্বেগ আর উত্তেজনার প্রভাব কাটাতে চাইছি শরীর থেকে। ক্লান্তি, দারুণ ক্লান্তি লাগছে-ভেঙে পড়তে চাইছে শরীর…তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়লাম, নিজেও জানি না।
সচেতন হওয়া মাত্র প্রথমে পানির শব্দ শুনতে পেলাম-স্বস্তিকর কুলকুল ধ্বনি। পেকোসের ঝর্না…পানি। চারটে দিন পানির আশায় হন্যে হয়ে ছুটেছে সাড়ে তিন হাজার গরু।
আকাশে ক্ষীণ ধূসর আভা। প্রায় দু’ঘণ্টা ঘুমিয়েছি, চাঁদ দেখে আন্দাজ করলাম।
গড়ান দিয়ে সিধে হয়ে বসে, মাথায় হ্যাট চাপালাম। সব শান্ত। নিস্তব্ধ। পায়ে বুট গলিয়ে গানবেল্ট ঝুলিয়ে আগুনের কাছে চলে গেলাম।
পেকোসের ধারে দেখা ছায়াঘেরা নদীর উঁচু তীরকে একটু আগে গাছপালা আর ঝোঁপ মনে করেছিলাম। নদী এখানে খোলামেলা-গাছ, গুলু বা ঝোঁপ কিছুই নেই। কেবল অল্প কয়েকটা লতা জাতীয় উদ্ভিদ জন্মেছে।
নদীর তীর বেশ উঁচু, পাড় থেকে পানি ছয় থেকে দশ ফুট গভীর। নদী প্রায় একশো ফুট প্রশস্ত, আর সবচেয়ে গভীর জায়গায় চার ফুট। ওপাশে পাহাড়ী ঢালে, বেলে মাটির জমিতে গ্রিজউড, বেঁটে মেস্কিট আর গুচ্ছাকারে বেড়ে ওঠা কিছু ঘাস জন্মেছে।
আগুনের কাছে এসে ঘোড়াকে পিকেট করল কার্ল ক্ৰকেট। স্যাডল ছেড়ে কফির কাপ হাতে বসে পড়ল।
চারপাশ শান্ত•••একেবারে নীরব। গরুগুলো শুয়ে পড়েছে, তবে ক্লান্ত ঘোচেনি ওদের। মাঝে মধ্যে দু’একটা নদীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু খানিক পরই সজাগ ক্রুদের তাগাদায় ফিরে আসছে।