ধুধু তাপতরঙ্গের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ সংবিৎ ফিরে পেলাম, মনে পড়ল কেন এখানে এসেছি। কেন পশ্চিমে আসে মানুষ? এর আগে কখনও ভাবিনি, যদিও সুউচ্চ পর্বতাশ্রণীর নির্জনতা আর সুনীল আকাশের সাহচর্য যে-কাউকে ভাবুক করে তুলবে।
পশ্চিমে আসতেই হত, আমাদের, নয়তো অন্যদের সঙ্গে জমি ভাগাভাগি করতে হত। হয়তো এই দুর্ভোগের চেয়ে হার আউটফিটের সঙ্গে লড়াই করাই শ্রেয়ঙর ছিল। কিন্তু এই ড্রাইভ কি স্রেফ নতুন একটা ঠিকানা খুঁজে পাওয়ার প্রতিশ্রুতি? হয়তো অবচেতন মনে পশ্চিমে সুরে আসার ইচ্ছে ছিল আমাদের, নতুন এলাকা দেখার, নতুন জমি জয়ের আনন্দ ভেতরে ভেতরে তাড়া করেছে আমাদের।
রোমাঞ্চ বা অ্যাডভেঞ্চার-প্রিয় মানুষ সব সমাজেই থাকে, কিন্তু পশ্চিমা মানুষ স্বভাবগত অ্যাডভেঞ্চার প্রিয়। বহু লোককে ভাল জমি ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতে দেখেছি আমি, ভাগ্য পরীক্ষা করার ইচ্ছে তাদের শেষ হয় না কখনও।
দুবার ক্ষারীয় ওঅটরহোল চোখে পড়ল। সাদা ক্ষারের স্তর জমেছে পানির ওপর, সুপের চেয়েও ঘন, যে-কোন পশু মারা পড়বে এই পানি পান করলে।
এগিয়ে গেলাম আরও। উঁচু একটা জায়গায় উঠে ওপাশে পেকোসের লাগোয়া ঢেউ খেলানো প্রান্তর চোখে পড়ল। সরু রেখার মত গাঢ় একটা ঝিলিক দেখা যাচ্ছে পেকোসের কাছাকাছি। অধীর হয়ে সেদিকে ফিরল ঘোড়াটা। স্যাডল ছেড়ে রুমাল বের করে পানিতে চুবিয়ে ঘোড়ার নাক মুছে দিলাম দু’বার। তারপর ফিরতি পথের দিকে তাকালাম।
পাল থেকে ষোলো কি সতেরো মাইল এগিয়ে আছি আমি।
চোঙাকৃতির একটা পাহাড়ের ওপর থেকে গরুর পালটাকে আসতে দেখতে পেলাম। দৃশ্যটা করুণ, ভয়াবহ এবং হতাদ্যম হওয়ার মত। সবার সামনে বাবা, বরাবরের মতই মাথা উঁচু করে স্যাডলে বসে আছেন, কিন্তু ক্লান্তি, উদ্বেগ বা অস্থিরতা ঢাকতে পারেননি-অন্তত আমার দৃষ্টিতে ধরা পড়ছে ঠিকই। বিশ ফুট দূরে ডোরাকাটা বলদটা, পঞ্চাশ গজ পেছনে মূল পাল।
ঠিক পেছনে বেন টিল্টন আর জিম মুর। প্রথম দিকের গরুগুলোকে তাগাদার মধ্যে রেখেছে যাতে সঠিক পথে এগিয়ে যায়।
পুরো পালের ওপর ধুলোর আস্তর ছেয়ে আছে, যেন ধীর গতিতে এগিয়ে আসছে ধুলোর মেঘ। ক্ষারের উপস্থিতির কারণে মেঘটাকে সূর্যের আলোয় দেখাচ্ছে শুদ্র তুষারের মত। গরু, রাইডার আর ঘোড়াকে ঢেকে ফেলেছে…এমনকি ওয়্যাগনও ঢাকা পড়েছে।
পেছনে, ফেলে আসা ট্রেইলে কয়েকটা গরু দেখতে পাচ্ছি-দৃষ্টিসীমায় অন্তত দশ-বারোটা চোখে পড়ল। দুটো পড়ে গেছে, কয়েকটা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে, সেকেন্ড কয়েকের মধ্যে হয়তো লুটিয়ে পড়বে।
যাই হোক, শেষপর্যন্ত আসতে পেরেছে গরুর পাল-অন্তত বেশিরভাগ। পাহাড়ী ঢাল ধরে ট্রেইলের দিকে নেমে এলাম আমি।
বাবা, টিকতে পারবে শুধু এমন গরুকে নদীর দিকে নিয়ে যাব আমরা, বাবাকে বললাম। ভাগাভাগি না করে উপায় নেই। যে কটাকে নিয়ে যেতে পারব, বেঁচে যাবে ওগুলো।
থামলাম আমরা। চরম ক্লান্তির পরও কোন রকমে দাঁড়িয়ে আছে বেশিভাগ গরু, কিন্তু ভাগ করে ফেললাম আমরা-সেরাগুলোকে আলাদা করে ফেললাম। বাবার নেতৃত্বে ওগুলোকে নিয়ে তখনই পেকোসের হর্স হেডের দিকে যাত্রা করল মিলো আর গার্ট।
রৌদ্রদগ্ধ দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। পশ্চিমাকাশে নেমে গেছে। সূর্য। সোনালী গোলাপের শুভ্রতায় সেজেছে পশ্চিম আকাশ, মেঘের আড়াল থেকে ছিটকে বেরিয়ে এল সূর্যের শেষ রশ্মি, দীর্ঘ রক্তিম তীর যেন, মেঘের রক্তলাল বিছানা ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। নিচে বিস্তৃত পাহাড়শ্রেণীর ধূসর বাদামী শূন্যতা অদ্ভুত মায়া তৈরি করেছে, মেঘের দল ক্ৰমে কাঁধে কাঁধ মেলাচ্ছে, সাদা পেঁজা তুলোর মত বিশাল একেকটা প্রাসাদ উঠে গেছে স্বর্গের দুয়ার পর্যন্ত।
বহুবার এই সৌন্দর্যের কথা শুনেছি, কিন্তু নিজের চোখে এই প্রথম দেখলাম। অপূর্ব সুন্দর। শেষ বিকেলের সৌন্দর্য কখনও এতটা মনোমুগ্ধকর মনে হয়নি আজকের আগে। সামনে হর্স হেড ক্রসিং, কাছাকাছি পবর্তশ্রেণীর খাঁজকাটা চূড়ার ওপর অসীম শূন্যতা, তারওপর মেঘের দলের সঙ্গে বিকেলের সূর্যের আলোকমালা। এত উজ্জ্বল, প্রাণবন্ত, হৃদয়ছোঁয়া দৃশ্য-না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।
অটম্যানদের ওয়্যাগনের কাছে চলে এলাম আমি। চালাতে থাকো, ম্যাম, মিসেস অটম্যানকে বললাম। হর্স হেডের আগে থামছি না আমরা!
গম্ভীর, ক্লান্ত মুখে নড করল মহিলা। চাবুক আর মুখ চালিয়ে পরিশ্রান্ত ঘোড়াগুলোকে এগিয়ে যেতে বাধ্য করল। হাতের চেটো দিয়ে ঘর্মাক্ত মুখ মুছে আমার দিকে তাকাল ফ্রাঙ্ক কেলসি। হাসল। নরক, তাই না, বাছা? জীবনেও এমন দেখিনি!
এগোতে থাকো! এগোলাম আমি। জুয়ারেজ আর জুয়ানিতা আসছে পাশাপাশি তোমরাও, জুয়ানিতার উদ্দেশে বললাম, ভাইকে ধরে রেখেছে সে। পালের ব্যাপারে মাথা ঘামিয়ো না। পারলে আগে ভাগেই নদীর কাছে চলে যাও।
টকটকে লাল আর গোলাপী আভা বিদায় নিয়েছে আকাশ থেকে, নীল বা নীলচে রঙ গাঢ় হচ্ছে এখন। দূরে পাহাড়শ্রেণীর চূড়ার কাছাকাছি ঘন বেগুনী বর্ণ পেয়েছে আকাশ, বাতাসেও যেন সেই ছোঁয়া। গোধূলি লগ্নে, হর্স হেডের দিকে এগোল ক্লান্ত গরুর দল। চলার গতি খুবই ধীর, জিহ্বা বেরিয়ে পড়েছে, ওগুলোর, মাথা নিচু হয়ে গেছে। বদ্ধ মাতালের মত এগোচ্ছে ওরা, হেলে-দুলে, ছন্দহীন এবং ক্লান্ত চলন।