মাঝে মধ্যে পড়ে গেল দু’একটা, এ নিয়ে ভ্রুক্ষেপ করলাম না কেউ। ঘোড়ার গতি ধীর হয়ে গেছে, মাঝে মধ্যে থেমে গেল, তারপর মিনিট কয়েকের বিশ্রাম পেয়ে আবার এগোল।
দুপুরের মধ্যে প্রতিটি গরুর পাঁজরের হাড় বেরিয়ে পড়ল, বুনো দৃষ্টি ফুটে উঠেছে ওগুলোর চোখে। ডোরাকাটা বলদটা খেপে গিয়ে আক্রমণ করতে এল, কোন রকমে এড়িয়ে গেল ক্লান্ত পর্যুদস্ত পনিগুলো, ওটার পথ থেকে সরে গেল।
থেমে কফি তৈরি করলাম আমরা। রাইডাররা একে একে আসছে ক্যাম্পে। রক্তলাল চোখ সবার, ক্লান্তি এতটাই যে স্যাডল থেকে হেঁচড়ে নামছে। কেউ কেউ পড়েই গেল। তারপরও অভিযোগ করল না কেউ। জুয়ানিতাও রয়েছে এদের মধ্যে। গর্তে বসে গেছে ওর বড় বড় চোখ, কিন্তু আমার উদ্দেশে হাসল ও, ওকে বিশ্রাম নিতে বলায় মাথা নেড়ে নাকচ করে দিল।
আমার কাছে চলে এল অটম্যান। ড্যান, একেবারে পর্যুদস্ত সবাই। ঘোড়াগুলোর অবস্থাই বেশি খারাপ। বিশ্রাম নেওয়া ছাড়া উপায় নেই।
ঠিক আছে…দুটো ওয়্যাগনে সব মালপত্র তুলে ফেলল।
নিজেই ওয়্যাগনের দরজার কাছে চলে এল জুয়ারেজ। আমি রাইড করতে পারব। এখন রাইড় করাই উচিত।
জুয়ারেজ জেদী মানুষ, মানা করলেও শুনবে না। তাছাড়া রাইড করলেই সাহায্য হবে, যদিও নিজের যত্ন করার সুযোগই সে পাবে না।
সব মালপত্র দুটো ওয়্যাগনে ভরা হলো। রদপত্র কমে এসেছে। বাদ পড়া ওয়্যাগনের ঘোড়া অন্য দুটোয় জুড়ে দেয়া হলো।
গরুর খুরের দাপটে ধুলো উঠছে, ভারী করে তুলেছে বাতাস। মাথার ওপর গনগনে সূর্য তপ্ত হক্কা ছড়াচ্ছে, দূরে দিগন্তের কাছাকাছি তাপতরঙ্গ নাচছে, মরীচিকা দেখা যাচ্ছে প্রায়ই। প্রতিটি মাইল এগোনোর সঙ্গে সঙ্গে আরও অস্থির হয়ে উঠছে গরুগুলো, বারবার পেছনে পড়ে যাচ্ছে, খেদিয়ে কিংবা পাছায় চাপড় মেরে পালের সঙ্গে তাল মেলাতে বাধ্য করা হলো ওগুলোকে।
মাঝে মধ্যে বয়স্ক গরু পড়ে গেল, ময়দার বস্তার মত ঢলে পড়ল, মারাও গেল তৎক্ষণাৎ। তেষ্টা আর ধুলোর অত্যাচারে গলা জ্বলছে আমাদের, শুকনো খটখটে হয়ে গেছে মুখ, গলার স্বর মিইয়ে এসেছে সবার-তৃষ্ণার্ত গরু পালের ডাকের সঙ্গে একাকার হয়ে গেল। কিন্তু এর কোন শেষ নেই। এগিয়ে চলেছি আমরা, থামার মত জুতসই কোন জায়গা চোখে পড়ছে না।
দুপুরের পর থামতেই হলো। কয়েকটা গরু ঢলে পড়ল, একটা ঘোড়া মারা পড়ল। আকাশ যেন জ্বলন্ত একটা ছাদ, খরতাপ ঢলে পড়ছে জমিনের ওপর। ঘামে জবজব করছে আমাদের দেহ। গরুর পেটের ওপর অদ্ভুত আঁকাবাঁকা চিহ্ন ফুটিয়ে তুলেছে ঘামের রেখা।
দুর্ভোগের সঙ্গে সঙ্গে ক্রুদের মেজাজেরও অবনতি ঘটছে। অধৈর্য হয়ে উঠেছে সবাই। যখনই দরকার হলো, অন্যদের সাহায্য করলাম আমি, অন্য যে-কারও চেয়ে দ্বিগুণ ছোটাছুটি করছি, মরিয়া চেষ্টার যেন কোন শেষ নেই। ক্ষার মেশানো ধুলোয় গা চটচট করছে, প্রখর রোদ আর ঘামে কুঁচকে গেছে চোখজোড়া।
অমানুষিক শ্রমের পরও জুয়ানিতাকে ব্যস্ত এবং স্বতঃস্ফুর্ত দেখে সত্যিই বিস্মিত হলাম। অন্য যে-কোন লোকের সমান কাজ করেছে ও, মেয়ে বলে বিশেষ সুবিধা নেয়নি। এমনকি জুয়ারেজও হাত গুটিয়ে বসে ছিল না, মাঝে মধ্যে ওকে দেখেছি দলছুট গরু খেদিয়ে পালে ঢোকাতে।
ক্লান্ত দিশেহারা গরুগুলো লড়ছে অবসাদ, ক্ষুধা আর তৃষ্ণার সঙ্গে, মাঝে মধ্যে টলমল পায়ে সিধে হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। কোন কোনটা পড়ে গেল দড়াম করে, কিন্তু ওগুলোকে এগিয়ে যেতে বাধ্য করলাম আমরা।
পাল ছেড়ে এগিয়ে গেলাম আমি। স্কাউটিং করে ক্ষারে পূর্ণ ওঅটরহোলগুলো খুঁজে বের করতে হবে। ট্যাপ এ সম্পর্কে সতর্ক করেছিল আমাদের।
হাজারবার মনে হলো, ও সঙ্গে থাকলে কত ভাল হত, হাজারবার বাড়তি একজন লোকের জন্যে আফসোস হলো। পুরো তিনদিন কোন রকম বিরতি ছাড়াই এগিয়ে চলেছি আমরা, এক ফোঁটা ঘুমাইনি কেউ। স্রেফ কফি গিলে স্যাভলে চেপে বসেছি, ঘাম আর ধুলোর অত্যাচারে দৃষ্টিশক্তি কমে গেছে অর্ধেক। গরুগুলোকে পালের মধ্যে রাখতে রীতিমত লড়াই করতে হচ্ছে। এখোনো ছাড়া উপায় নেই। পানিই ওদের বাঁচিয়ে রাখতে পারে, এবং পানির কাছে পৌঁছতে হলে এগোতেই হবে।
ডোরাকাটা বলদটা নেতৃত্ব দিচ্ছে এখনও। প্রায় দিশেহারার মত এগোচ্ছে ওটা, অদম্য মনোবল নিয়ে লড়ে চলেছে ক্লান্তির সঙ্গে, যেন আমাদের মরিয়া প্রয়াস আর প্রয়োজন আঁচ করতে পেরেছে ওটা
প্রতিদিনই জ্বলন্ত উনুনের মত তাপ ছড়িয়ে দিচ্ছে সূর্য। ঠাণ্ডা শীতল রাত্রিতেও থামলাম না আমরা। অনেক গরু পড়ে গেল। পা ছড়িয়ে স্থির দাঁড়িয়ে থাকল। মাথা নুয়ে পড়েছে ওগুলোর। এ পর্যন্ত কত গরু খোয়া গেছে?
সময় সম্পর্কে সমস্ত জ্ঞান লোপ পেয়েছে আমাদের। গরুগুলোকে সামলানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে, প্রচণ্ড তাপ আর ধুলোর অত্যাচারের মধ্যেও মরিয়া হয়ে ওগুলোকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি।
স্কাউটিঙের সময় মাসট্যাঙ পুল আবিষ্কার করলাম আমি, কিন্তু দেখে হতাশ হলাম। কাদার ওপর সামান্য পানি আছে এ মুহূর্তে। গত কয়েক মাসেও পানি ছিল না এখানে। ফ্ল্যাটরক হোলসের ক্ষেত্রেও একই অভিজ্ঞতা হলো, নদীর এপাশে পানির কোন নমুনা চোখে পড়ল না। দূরে, উত্তরে ওয়াইল্ড চেরি হোলস রয়েছে, কিন্তু ভিন্ন রুট ওটা, তাছাড়া ওখানে পানি আছে কিনা সেটাও জানা নেই আমাদের।