ওয়াগনগুলো নড়ে উঠল, ভারী চাকা গড়াল ঘড়ঘড় শব্দে, ধীর গতিতে এগোতে থাকল গরুর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। পশ্চিমে এগোচ্ছি আমরা। খুরের দাপটে ধুলো উড়ছে, পেছনে উদীয়মান সূর্যের আলো ঝিলিক মারছে হাজারো শিং-এ। পালের একপাশ থেকে গান ধরল কেউ, সুর মেলাল অন্য একজন; ওদের গান শুনতে পেয়ে সন্তুষ্ট হলাম-দীর্ঘ ড্রাইভ শেষ করার জন্যে যে সাহস, ধৈর্য আর সহিষ্ণুতা দরকার, তার সবই দরকার হবে নিকট ভবিষ্যতে-হর্স হেড পর্যন্ত, আশি মাইল পাড়ি দেয়ার সময়।
হেলে-দুলে এগিয়ে চলেছে গরুর পাল, চিৎকার করছে, ডাক ছাড়ছে। ধুলো আরও ঘন হয়ে এসেছে। সতেজ সকাল পেরিয়ে রৌদ্রদগ্ধ দুপুর হলো একসময়। ঘামের ফোঁটা নেমে আসছে গরুর পেট বেয়ে। কিন্তু থামলাম না আমরা। প্রতিটি পদক্ষেপ বিজয়ের দিকে একেকটা মাইলফলক, প্রতিটি মাইল মানে পানির আরও নিকটবর্তী হওয়া। কিন্তু আমার জানা আছে, পালে অনেক গরু পানি স্পর্শ করার আগেই মারা পড়বে, কিছু ঘোড়াও, হয়তো মানুষও মারা যাবে।
বুনো পশ্চিমের রীতি এমনই কঠিন, পরিশ্রমী মানুষ এভাবেই এগিয়ে চলে; এটাই তাদের জন্যে একমাত্র পথ, উপায়-রীতি, এবং পছন্দও। যত এগোবে, ততই তেষ্টা বেড়ে যাবে। এদিকে সকালের সূর্যও তপ্ত হলকা ছড়াচ্ছে বেরসিকের মত; সময় পেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে আরও তেতে উঠছে রোদ। ধুলোর অত্যাচার বাড়ছে।
দুপুরের আগে দু’বার ঘোড়া বদল করেছি। জিম মুরের সঙ্গে পালের পেছনে ড্রাগের দায়িত্বে আছি আমি। কার্ল ক্রকেটের সঙ্গে পালের সামনে রয়েছেন বাবা।
শেষপর্যন্ত প্রশান্তিময় ঠাণ্ডা রাত এল, যখন, যোলো মাইল পেরিয়ে থামলাম। একদিনের জন্যে যথেষ্টরও বেশি দূরত্ব। সবার মধ্যেই চাপা আতঙ্ক, স্রেফ যন্ত্রের মত চলছি আমরা, জানি সামনে কি আছে-ভেতরে ভেতরে এ নিয়ে আতঙ্কিত। জুয়ানিতা যখন আমার দিকে তাকাল, বিস্ময় দেখতে পেলাম ওর চোখে, জানি কি ভাবছে ও। ভাবছে আমরা পাগলামি করছি..অসম্ভব জেনেও চেষ্টা করছি এবং সর্বস্ব, বিসর্জন দিচ্ছি।
সাপার একেবারে সংক্ষিপ্ত হলো আজ। ভরপেট কফি গিললাম। এদিকে অস্থির হয়ে পড়েছে গরুর দল-পানি নেই, তেষ্টা মেটাতে পারছে না। অনেক, অনেকক্ষণ ধরে ছটফট করল ওরা, একসময় ক্লান্ত দেহে শুয়ে পড়ল।
সমস্ত দায়িত্ব এখন আমার কাঁধে। একে একে সবার মুখ জরিপ করলাম, সময় নিয়ে নিরীখ করলাম সবক’টা মুখ। বোঝার চেষ্টা করলাম, কতটা সহিষ্ণুতা বা ধৈর্য দেখাতে পারবে এরা। এদের সামর্থ্যই বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন।
বেশ রাত করে ঘুমালাম। সকালে উঠলাম সবার আগে, বেডরোল গুছিয়ে ডানের পিঠে স্যাডল চাপালাম। আগুনের কাছে ফিরে এসে দেখলাম কফির আয়োজন করছে স্যাম গার্ট। তাজা জিনিস, আঙুল তুলে পাত্র দেখাল সে। নিয়ে নাও।
কাপ ভরে ওর বিপরীতে বসলাম।
কথাবার্তায় তেমন পটু নই আমি, হঠাৎ মন্তব্য কল গার্ট। সেজন্যেই কিছু বলিনি। বিশেষ করে, ট্যাপ যখন তোমার ভাই।
কফি গেলার ফাঁকে ওর দিকে তাকালাম, কিছু বললাম না।
ট্যাপ যদি আমাদের জন্যে ভোলা রেঞ্জ ঠিক করে থাকে-তাহলে এতদিনে কেউ বসতি করেনি কেন?
আশপাশে কেউ নেই বলেই বোধহয়।
ফালতু অজুহাত! ওই রেঞ্জে আগেও লোক এসেছে, জমি ব্যবহার করেছে-এমনকি তোমার জন্মের আগে থেকে, ড্যান।
তো, ব্যাপারটা ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না আমার। ট্যাপ ওই রেঞ্জ সম্পর্কে বলেছে আমাদের, কারও মালিকানা নেই, কাউকে জিজ্ঞেসও করতে হবে না, বিস্তৃত তৃণভূমি পড়ে আছে মাইলকে মাইল-কেবল দখল করে নিলেই হলো।
স্যাম গার্ট কথা কম বলে, এবং যা বলে তার সবই সত্যি-জানি আমি। না জেনে কখনোই কিছু বলে না সে। ট্যাপ নিজেই জায়গাটা খুঁজে বের করেছে, আমাদের জন্যে, প্রতিবাদ করলাম আমি। একজন লোক রেখে এসেছে ওখানে।
হোনাস গান্টকে?
তুমি চেনো ওকে!?
হাসি পাচ্ছে আমার, ড্যান। হোনাস গান্ট জঘন্য চরিত্রের লোক। ট্যাপের মুখে ওর কথা শুনেছি বেশ কয়েকবার, স্রেফ ঝামেলা এড়ানোর জন্যেই কিছু বলিনি। প্রতিবাদ করতে যাওয়া মানেই ট্যাপকে মিথ্যুক বলা, তাই না? আমি গানফাইটার নই, তাই ট্যাপের ধারণা ভুল প্রমাণ করার জন্যে ভুয়েল লড়তে রাজি নই। সত্যি কথা হচ্ছে, ওই হোনাস লোকটা গরুচোর এবং আউটল।
এই তাহলে অবস্থা। রুক্ষ বিরান প্রান্তর ধরে পশ্চিমে ছুটছি আমরা, জীবন আর জীবিকার ঝুঁকি নিয়েছি, মনে স্বপ্ন যে একেবারে আনকোরা একটা জায়গায় বসতি গড়ব; যে-জমির স্বপ্ন বুকে নিয়ে এই দুর্ভোগ পোহানো, এখন দেখা যাচ্ছে সেটা আরেকজনের জমি এবং ওখানে পৌঁছে হয়তো পুরোদস্তুর লড়াই করতে হবে আমাদের।
সবাই বলে বিপদ একাকী আসে না; আমাদের বর্তমান অবস্থায় কথাটা একশো ভাগ সত্যি। কফি গেলার ফাঁকে পরিস্থিতি নিয়ে ভাবছি, কিন্তু কোন সমাধান খুঁজে পেলাম না। পশ্চিমে যেতেই হবে আমাদের, ফিরে যাওয়ার উপায় নেই, অথচ গন্তব্যে পৌঁছে লড়াই করতে হবে-পৌঁছব যখন, আমরা থাকব ক্ষুৎপিপাসায় কাতর। গরুগুলোর অবস্থা এরচেয়ে ভাল থাকবে, তা বলা যায় না।
স্যাম, ব্যাপারটা আমাদের দু’জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকুক। আপাতত কাউকে কিছু জানাব না। এ নিয়ে ভাবতে হবে। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, ট্যাপের আরও খোঁজখবর নেয়া উচিত ছিল।