আনন্দ নিজে তৈরি করে নেয় পশ্চিমের মানুষ, এখানকার মাটিতেই রয়েছে আনন্দের উৎস। জীবিকার পদ্ধতিও আনন্দ যোগায় মানুষকে। খাবার, পরিধেয় বস্ত্র, বাড়ি, করাল, বার্ন-সবই নিজেরা তৈরি করে নেয়। একসঙ্গে থাকছে এমন সব মানুষ অন্যের সামর্থ্য, সাহস বা সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখে।
এটা এমন এক দেশ, যেখানে নিজের ঘোড়ায় নিজেকে ব্ল্যাডল পরাতে হয়, যার সমস্যা তাকেই মোকাবিলা করতে হয়। লড়াই যার যার নিজস্ব। একজন মানুষের বিচার তার কাজে। প্রয়োজনের সময় কাজটা সে করতে পারল কিনা, এতেই তার দক্ষতার বিচার! সাফল্য ব্যর্থতার হিসেব খুব সহজ।
আমি ড্যান ট্রেভেন। কাউহাউস ক্রীকের তীরে এক কেবিনে জন্ম। আমার জন্মের মুহূর্তে আনন্দ করার উপায় ছিল না বাবার, বরং নিজের এবং সবার প্রাণের জন্যে লড়াই করছিলেন তিনি। বাবা আর ফ্রেড চাচা মারকুটে ইন্ডিয়ানদের কোন রকমে ঠেকিয়ে রেখেছিলেন। মা-র জঠর থেকে এই পৃথিবীতে এসে প্রথমে গানপাউডারের কটু গন্ধ নাকে নিয়েছি আমি, শুনেছি বাফেলো গানের কান ফাটানো গর্জন। সন্তান জন্ম দেয়ার আনন্দ নিয়ে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করলেন মা, ছেলেকে স্তন্যদান বা মানুষ করার সৌভাগ্য তার হয়নি। মা মারা যাওয়ার পর এক মেক্সিকান মহিলার যত্নে বড় হয়েছি আমি।
আমার যখন ছয় বছর চলছে, ফোর্ট ওঅর্থে বাবার সঙ্গে পরিচয় হয় ট্যাপের মা-র। বিধবা এই মহিলাকে বিয়ে করে পশ্চিমে নিয়ে আসেন বাবা, সঙ্গে ট্যাপও আসে।
যদূর মনে পড়ে সুন্দরী ছিলেন আমার দ্বিতীয় মা। ট্যাপ বা আমার মধ্যে কখনও পার্থক্য করেননি, সাংসারিক কাজেও অনীহা ছিল না ওঁর। কিন্তু কিছুদিন যেতেই পশ্চিমের রুক্ষ জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে ব্যর্থ হলেন বেচারী। সামান্য এক ড্রিফটারের সঙ্গে চলে গিয়ে পশ্চিমকে বিদায় জানান তিনি। সেই থেকে ট্যাপ আমাদেরই একজন।
মা-কে হারিয়ে মোটেও দুঃখী বা বিষাদগ্রস্ত মনে হয়নি ট্যাপকে। সবসময় নিজের ওজন নিয়ে চলাফেরা করত সে, বলা যায় তারও বেশি। ওর আচরণে মনে হত এখানেই জন্মেছে। মাত্র তেরো বছর বয়সে পূর্ণবয়স্ক লোকের কাজ করত, এ নিয়ে অহঙ্কারও করত। একজন যুবক বা তরুণের সঙ্গে বালকের পার্থক্য আসলে দৃষ্টিভঙ্গি বা বড়জোর দায়িত্ববোধের-কোন ছেলে যদি সাফল্যের সঙ্গে পূর্ণবয়স্ক পুরুষের দায়িত্ব পালন করে, এ নিয়ে গর্ব বোধ করার অধিকার আছে তার।
যাই আমরা করি না কেন, বয়সে বড় হওয়ায় নেতৃত্ব বরাবরই ওর হাতে থাকত। স্কুলে পড়ার সময় প্রায়ই মারামারি হত তাগড়া ছেলেদের সঙ্গে; কুলিয়ে উঠতাম না যখন, সবসময় আমার পাশে এসে দাঁড়াত ট্যাপ।
সতেরো বছর বয়সে প্রথম বাড়ি ছাড়ে ও। অ্যারিজোনার বিগ থিকেটের এক আউটফিটে কাজ করার পর বছর খানেক বাদে যখন বাড়ি ফিরে এল, বয়স্কদের মত কোমরে পিস্তল, ঝোলাতে দেখলাম ওকে। অবশ্য ও পৌঁছা’র আগেই গুজব শুনেছি-কেডো লেকের কাছাকাছি এক লোক নাকি খুন হয়েছে ওর হাতে।
এরপর থেকে বাড়ি এলে প্রচুর খাটত ও, কোন কাজে গাফিলতি করত না; নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকত, কারও ব্যাপারে কখনও নাক গলাত না-একেবারে নির্ঝঞ্ঝাট একজন মানুষ যেন। বাবা খুব কমই কথা বলতেন ওর সঙ্গে, মাঝে মধ্যে হয়তো দু’একটা মন্তব্য করতেন বা নির্দেশ দিতেন; মন দিয়ে শুনত ট্যাপ, কিংবা শোনার ভান করত। কিন্তু বছরের বেশিরভাগ সময় বাইরে থাকত সে, এবং প্রতি বছর যখন ফিরে আসত, প্রতিবারই আরও সমর্থ, পোড়-খাওয়া আর দুর্দান্ত মনে হত ওকে।
এবার পাক্কা তিন বছর পর ফিরেছে ট্যাপ। বলা যায় মোক্ষম সময়ে এসেছে-যখন ওকেই সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল আমাদের। বেপরোয়া সেটলারদের উৎপাত চলছে বেসিনে, প্রায়ই গণ্ডগোল হচ্ছে। আরও পশ্চিমে সরে গিয়ে মুক্ত জমি ক্লেইম করার এখনই সময়।
এখানে তেমন কিছুই রেখে যাব না আমরা। একেবারে শুরুতে, বাবা যখন প্রথম..এসেছিলেন, ইন্ডিয়ানদের হামলার ভয়ে কেউই একা থাকার সাহস করত না; কাছাকাছি থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সবাই। তাদের কেউ মারা গেছে, কেউ খুন হয়েছে, কেউ এলাকা ছেড়ে ভেগেছে কিংবা জমি বেচে চলে গেছে। দেশটা এভাবেই বদলে গেছে। আর এখন রেঞ্জের দখল নিয়ে কামড়াকামড়ি লেগে গেছে। পরিস্থিতি এত খারাপ যে হয়তো শিগগিরই লড়াই বেধে যাবে।
নতুন বসতি করতে আসা অনেকেরই নিজস্ব গরু নেই। মাংসের প্রয়োজনে আমাদের গরু জবাই করেছে ওরা। ওদের বাচ্চা আর মহিলারা খিদেয় কষ্ট পাবে, শুধু এ কারণে ব্যাপারটা মেনে নেন বাবা। কিন্তু আরও সাহসী হয়ে উঠল ওরা-সমস্যারও শুরু হলো তখন থেকে শুধু মাংসের চাহিদা মিটিয়ে ক্ষান্ত হয়নি সেটলাররা, বরং গরু সরিয়ে বেচতে শুরু করল।
দু’বার হাতে-নাতে ওদের ধরেছি আমি, গরু ফিরিয়ে নিয়ে এসেছি; কিন্তু নিরস্ত হবে কি, উল্টো আড়াল থেকে আমার উদ্দেশে কয়েকবার গুলি করেছে ওরা।
দিনকে দিন পশ্চিমে আসছে মানুষ। ভাল-মন্দ সব ধরনের মানুষই আসছে। আগে দেখেছি হাড়ভাঙা পরিশ্রম করত এরা, নিজের যা আছে তাতেই সন্তুষ্ট থাকত, কিন্তু আমাদের নতুন প্রতিবেশীরা সম্পূর্ণ ভিন্ন ধাতের-আমাদের উপার্জন থেকে নিজেদের জীবিকা নির্বাহের পথটাই যৌক্তিক মনে হয়েছে ওদের কাছে। এভাবেই ঝামেলার শুরু।