এর আগে ট্যাপের সঙ্গে কখনও দেখা হয়নি কার্লের-ব্যাপারটা উদ্বিগ্ন করে তুলল আমাকে, কারণ ওরা দু’জনেই কঠিন মানুষ এবং অপছন্দ বা অসন্তোষ প্রকাশ করতে গিয়ে প্রায়ই ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে ফেলে ট্যাপ।
তাহলে যাচ্ছি আমরা? বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম। সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে গেছে?
হ্যা…পশ্চিমে যাচ্ছি আমরা, ড্যান।
টিম অটম্যান আমাদের প্রতিবেশী। ছোট্ট একটা আউটফিটের মালিক হলেও প্রায়ই আমাদের হয়ে কাজ করে। দোহারা গড়নের গম্ভীর চেহারার মানুষ। সৎ। এটাই বোধহয় মোক্ষম সময়, মন্তব্যের সুরে বলল সে। কারণ তৃণভূমিতে ঘাসের সাইজ ছোট হয়ে গেছে, আর প্রতিবেশীরাও আমাদের বিরুদ্ধে চলে গেছে।
জায়গাটা কত দূরে?
ছয়শো মাইলের মত, বেশিও হতে পারে। নিউ মেক্সিকোয়। যত দেরি হবে যেতে, ভাল জায়গার দখল পাওয়ার সম্ভাবনা ততই কমে যাবে।
কত গরু নিয়ে যেতে পারব আমরা, ড্যান? জানতে চাইলেন বাবা।
ইদানীং আমার মতামতের যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছেন তিনি, মনোযোগ দিয়ে শোনেন সব কথা; যদিও এখনও তিনিই এই আউটফিটের সর্বেসর্বা। বাবাও জানেন এটা, কিন্তু আমার বিচার-বুদ্ধির ওপর আস্থা আছে ওঁর, বছর দুই আগে গরুর ব্যবসা আমার ওপর ছেড়ে দেয়ার পর থেকে সেই আস্থার পরিমাণ বেড়েছে বৈ কমেনি।
ট্যাপ এডলের চোখে বিস্ময় দেখতে পেলাম। স্বাভাবিক, এখনও আমাকে একটা বাচ্চা ছেলে মনে করে ও। স্রেফ দুধের বাচ্চা। ঘুণাক্ষরেও আশা করেনি এমন গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়ে আমার পরামর্শ চাইবেন বাবা।
হাজার তিনেক হবে বোধহয়। তবে বেশি ধরে নেয়াই ভাল। টিমের নিজস্ব তিনশো গরু রয়েছে, রাস্টিরও এরকম হবে। সব গরু রাউন্ড-আপ করার পর…তিন হাজার তো হবেই।
এত বিশাল গরুর পাল! অথচ তুলনায় আমাদের লোকজনের সংখ্যা কম হয়ে যাবে, চিন্তিত ভঙ্গিতে মন্তব্য করল ট্যাপ!
তিনটে ওয়্যাগন থাকবে। আর ঘোড়ার পাল তো আছেই।
ওয়্যাগন? প্রতিবাদ করল ট্যাপ। ওয়্যাগন নেয়ার পরিকল্পনা তো আমি করিনি!
পরিবার আছে আমাদের, বলল টিম অটম্যান। তাছাড়া সবারই টুকিটাকি জিনিসপত্র নিতে হবে।
কি কি নিতে হবে, ট্রেইলের সম্ভাব্য সমস্যা, লোকসংখ্যা নিয়ে আলোচনা শুরু হলো এবার। করালের রেইলে শরীর ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম আমি, টুকরো টুকরো কথা কানে আসছে, কিন্তু মনোযোগ দিচ্ছি না তেমন। এ ধরনের যাত্রায় প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি কথা বা আলোচনা হয়, কোন কাজে আসবে না এসব। সিদ্ধান্তটা শেষপর্যন্ত আমাকেই নিতে হবে। যা ভাল মনে হবে, তাই করব।
এ ধরনের ফলাফলহীন আলোচনায় নির্দিষ্ট কোন বিষয় থাকে না, যদিও, বিভিন্ন সমস্যার ব্যাপারে কিছু কিছু ধারণা হতে পারে। বহু আগে, প্রথম যখন পশ্চিমে যাওয়ার কথা উঠেছিল, এ নিয়ে ভেবেছি আমি এবং মোটামুটি একটা পরিকল্পনা দাঁড় করিয়েছি। কার্ল গম্ভীর স্বভাবের বা মিতভাষী হলেও সুবিবেচক, খুঁটিনাটি কয়েকটা ব্যাপারে পরামর্শ দিয়েছে আমাকে।
বড়জোর বারোজন লোক পাব আমরা, কাজের তুলনায় নেহাত কম। গরুর পাল ট্রেইলে অভ্যস্ত হয়ে গেলে সামলাতে তেমন সমস্যা হবে না, চার-পাঁচজন ক্রুই তখন ড্রাইভ পরিচালনা করতে পারবে, কিন্তু ততক্ষণ পর্যন্ত গরু সামলানোর কাজটা সত্যিই কঠিন হবে। বয়স্ক অনেক গরু ঝোঁপঝাড়ে অনেক দিন থাকায় প্রায় বুনো হয়ে পড়েছে, চেনা এবং অভ্যস্ত রেঞ্জ ছেড়ে হঠাৎ সরতে চাইবে না এখন।
আমাদের নিজস্ব কিছু সমস্যাও দেখা দেবে, যদিও পরস্পরের পরিচিত সবাই। লোকালয় ছাড়িয়ে কোমাঞ্চি এলাকা পেরোতে হবে, ওখানেই বিপদের যত ভয়।
দারুণ ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রা। সর্বস্ব হারানোর ঝুঁকি নিতে হবে আমাদের।
এখানেই থাকতে পারি আমরা, মাটি কামড়ে লড়তে পারি; কিন্তু টিকে থাকার সম্ভবনা একেবারে ক্ষীণ। এখন আর লড়াই করার মত সামর্থ্য নেই বাবার, যদিও দু’জন মানুষের সমান সাহস আছে ওঁর। মেক্সিকান বা ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে যুদ্ধ করে মানসিক ভাবে এমনিতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। ফাইভ কাউন্টিতে বড় হয়েছেন বলে ফিউড কি জিনিস ভাল করেই জানেন। বোঝেন এই রক্তারক্তি ব্যাপার দিনকে দিন চলতে থাকবে, একজন একজন করে খুন হয়ে যাবে, অথচ রাসুলিঙের সমস্যার আশু কোন সমাধান হবে না।
পাঁচ-দশটা গরু একজন মানুষের জীবনের চেয়ে কখনোই বড় হতে পারে না। কিন্তু দুদিন পরপর পাঁচ-দশটা করে গরু চুরি হতে দেখলেও ভাল লাগবে না কারও। গত এক বছরে অন্তত কয়েকশো গরু খোয়া গেছে আমাদের।
বাবার মত আমিও মনে করি রাসলারদের সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ার চেয়ে বরং অন্য কোথাও চলে যাওয়াই শ্রেয়। তাই ট্যাপ এডলে প্রস্তাবটা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে লুফে নিয়েছেন বাবা।
এখানেও ঝুঁকি আছে। রুক্ষ দুর্গম ট্রেইল পাড়ি দিয়ে ছয়শো মাইল যেতে হবে। পদে পদে রয়েছে বিপদের আশঙ্কা। খরা, রোদ আর পানির অভাবে মারা পড়তে পায়ে অসংখ্য গরু, হয়তো দেখা যাবে অর্ধেক পথ যাওয়ার আগেই বেশিরভাগ গরু মারা গেছে। ইন্ডিয়ানদের হাতে খুন হয়ে যেতে পারি আমরা কিংবা আমাদের পাল কেড়ে নিতে পারে ওরা।
আসলে কোন কাজে ঝুঁকি নেই? নিঠুর পশ্চিমে নিঃসঙ্গ ও কঠিন জীবনে অভ্যস্ত মানুষ আমরা, জানি কঠোর পরিশ্রম ছাড়া এখানে কিছু অর্জন করা অসম্ভব; নেহাত একঘেয়ে আর কষ্টকর এই জীবনও আনন্দমুখর হয়ে ওঠে প্রাণের জয়গানে-ক্যাম্পের মামুলি গল্প আর গলা ছেড়ে গাওয়া গান অফুরন্ত প্রাণপ্রবাহ ছড়িয়ে দেয় সবার মধ্যে, ক্লান্তি বা অবসাদ ঘুচিয়ে দেয়, আরও একটা কষ্টকর ও কর্মচঞ্চল দিন কাটানোর উদ্যম যোগায়…স্বপ্ন দেখায়।