- বইয়ের নামঃ অপঘাত
- লেখকের নামঃ গোলাম মাওলা নঈম
- সিরিজঃ ওয়েস্টার্ন সিরিজ
- প্রকাশনাঃ সেবা প্রকাশনী বই
- বিভাগসমূহঃ ওয়েস্টার্ন, অ্যাডভেঞ্চার
অপঘাত
১. উঁচু বোল্ডারসারি
উঁচু বোল্ডারসারি ঘিরে রেখেছে জায়গাটাকে, খানাখন্দে ভরা এক চিলতে খোলা জায়গা; পাশে দীর্ঘ পাহাড়ী ঢল নেমে গেছে বিস্তীর্ণ তৃণভূমিতে। জায়গাটাকে কাউ-হাউস বলে সবাই, কারণ ক্ৰীকের পাড়ের ছোট ছোট গুহায় লুকিয়ে থাকে কিছু গরু। সঙ্কীর্ণ ট্রেইল ধরে হঠাৎ উপস্থিত হলেন বাবা। আমি তখন তৃণভূমিতে খেদিয়ে নিয়ে যাচ্ছি কয়েকটা বলদকে, মাছির অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে ওগুলো।
বাড়ি এসো তো, বয়। ট্যাপ এসেছে। পশ্চিমে কোথায় নাকি ভাল জমি আছে-তাই বলছে ও সবাইকে।
বাবার কণ্ঠে পরিষ্কার আগ্রহ। ট্যাপ এডলে এতদিন পর বাড়ি ফিরেছে, শুধু এটাই ওঁর জন্যে বড় সুসংবাদ। আমার জন্যেও। কথাগুলো বলার পর দাঁড়ালেন না বাবা, ঘোড়া ঘুরিয়ে ফিরতি পথ ধরলেন।
ল্যাসো গুটিয়ে পমেলের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখলাম আমি, স্যাডলে চেপে র্যাঞ্চহাউসের দিকে এগোলাম।
মিনিট দশেকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম।
আমাদের টেক্সাস হাউস-এর পোর্চে ভিড় জমে গেছে তখন। ট্যাপ এডলেকে ঘিরে ছোটখাট একটা ভিড় চোখে পড়ল। বিশ গজ দূরে পোর্চের এপাশে আরও কয়েকজন নিজেদের মধ্যে আলাপ করছে কোন বিষয় নিয়ে।
ব্যাপারটা নতুন নয়, কারণ কিছুদিন ধরে এ নিয়ে বিস্তর তর্ক, আলোচনা আর পরামর্শ চলছে। সবাই বুঝতে পারছে দেয়ালে ঠেকে গেছে আমাদের পিঠ। একটা কিছু করতে হবে। হয় এখানে থেকে প্রতিবেশীদের সঙ্গে রক্তসংগ্রাম করে টিকে থাকতে হবে, নয়তো টেক্সাস ছাড়িয়ে আরও পশ্চিমে সরে যেতে হবে নতুন কোন বসতির খোঁজে।
ট্যাপ এডলে দীর্ঘদেহী যুবক। সাতাশ-আটাশ হবে বয়েস। শৈশব আর কৈশোর একসঙ্গে কেটেছে আমাদের, যদিও আমার চেয়ে ছয় সাত বছরের বড় ও। কঠিন, বেপরোয়া যুবক; রোমাঞ্চপ্রিয় এবং কিছুটা হলেও ছন্নছাড়া স্বভাবের। কাউহ্যান্ড হিসেবে প্রথমসারির। অস্ত্রে দারুণ দক্ষ।
লোকজনের ভিড়ের মধ্যেও ঠিক নজরে পড়ে ট্যাপকে। ছয় ফুটেরও বেশি লম্বা ও, একশো নব্বই পাউন্ড ওজন। ঝালর দেয়া ঝলমলে নীল শার্ট পরনে, নিপুণ ভাবে ইস্ত্রি করা নিচের দিকে দু’পাশে বোতামের সারি; আর রয়েছে শটগান চ্যাপস, লাল ব্যান্ডানা, স্প্যানিশ বুট এবং বড়সড় ক্যালিফোর্নিয়া স্পার। সব মিলিয়ে চোখ ধাঁধানো উপস্থিতি।
এখনও মুক্তো বসানো হাতলের সেই সিক্সশূটারটা শোভা পাচ্ছে। ওর হোলস্টারে। পিস্তলটা ছিল এক বন্দুকবাজের, ট্যাপের হাতে খুন হয় সে।
ট্যাপ আমাদের বন্ধু, এবং এক হিসেবে আমার ভাইও বটে।
সব ক’জনের মাথা ছাড়িয়ে গেছে ও। দূর থেকে চোখাচোখি হলো আমাদের। নির্লিপ্ত কিন্তু সাবধানী দৃষ্টি ওর চোখে। এ চাহনি পরিচিত আমার, কিন্তু আজই প্রথম এভাবে আমাকে মাপছে ও। চাহনির মত অর্থটাও জানি আমি: বিরোধিতা বা অসহযোগিতার আশঙ্কা করছে ও! কেউ ওর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে, সন্দেহ হওয়া মাত্র ট্যাপের চোখে এ চাহনি ফুটে ওঠে।
ড্যানি? ড্যান, বয়! ভিড় ঠেলে দ্রুত পায়ে এগিয়ে এল ও, একটা হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। আরিব্বাপস্! তুমি দেখছি সত্যিই পুরুষ মানুষ হয়ে গেছ! ভাবতেই পারিনি এতটা লায়েক হয়েছ!
স্যাডল ছেড়ে ট্যাপের হাত চেপে ধরলাম। টের পেলাম দৃঢ় মুঠিতে আমার হাত চেপে ধরেছে ও, চাপ দিচ্ছে। মনে পড়ল নিজের বাহুবলের ওপর কতটা অহংকার বোধ করে ট্যাপ। সেকেন্ড খানেক সমানে সমান চাপ প্রয়োগ করলাম, তারপর হাত শিথিল করে দিয়ে ইচ্ছেমত চাপ দিতে দিলাম ওকে, যেহেতু ট্যাপকে পছন্দ করি আমি এবং নিজের জোর প্রমাণ করার খায়েশ নেই আমার।
ট্যাপ এডলের সামনাসামনি দাঁড়িয়ে খানিক বিস্মিতই হলাম, কারণ চোখে চোখ রেখে দাঁড়িয়েছি আমরা-ওর দিকে তাকাতে এতটুকু চোখ তুলতে হলো না আমার। অথচ আগে কত লম্বা মনে হত ওকে!
ব্যাপারটা বোধহয় ট্যাপকেও বিস্মিত করেছে।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে, দৃষ্টি নিচু হয়ে গেল ওর, আমার কোমর হয়ে ঊরুতে গিয়ে ঠেকল; কিন্তু এই মুহূর্তে নিরস্ত্র আমি। রেঞ্জে কাজ করার সময় কোন কাউবয় কোমরে পিস্তল বহন করে না। স্ক্যাবার্ডে রাইফেল আর পমেলের সঙ্গে ঝুলন্ত খোপে ছুরি রেখে এসেছি।
পশ্চিমে যাচ্ছি আমরা, ড্যানি! আমার কাঁধে হাত রেখে বলল ট্যাপ। ঘুরে বাড়ির দিকে এগোলাম আমরা। পোর্চের এক কোণে রাস্টি বুচার্ড আর টিম অটম্যানের সঙ্গে কথা বলছেন বাবা। জায়গাটা আমি নিজে দেখে এসেছি। ঘাস বা পানির অভাব নেই।
সকৌতূহলে আমাদের দুজনকে দেখছেন বাবা। অবশ্য শুধু বাবাই নন, পোর্চের অন্ধকার কোণে দাঁড়ানো কার্ল ক্রকেটের নজরও আমাদের ওপর। ওর সবুজ চোখে অদ্ভুত ঔজ্জ্বল্য। দীর্ঘ ধূসর চুলের রাশি ছড়িয়ে আছে কাঁধের ওপর, মেয়েদের মতই সযত্নে আঁচড়ানো; স্প্যানিশ হ্যাটের ব্রিমের নিচে চোখজোড়ায় মাপা, সতর্ক এবং কঠিন চাহনি।
কার্ল ক্ৰকেট আমার বন্ধু। হাতে গোনা কিছু বন্ধু আছে ওর, কারণ স্বল্পভাষী, নিঃসঙ্গ এবং নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকা মানুষের বন্ধুর সংখ্যা সাধারণত কমই থাকে। মাঝারি উচ্চতা, কিন্তু প্রশস্ত কাঁধের কারণে খাটো দেখায় ওকে। লাগসই স্প্যানিশ জ্যাকেট আর বাকস্কিনের বেল বটম ব্রীচে মন্দ লাগছে না ওকে।