এই জংলীগুলোর উপাস্য দেবতা ঐ বিড়াল। ওটার এহেন দশা দেখে খেপে উঠলো ওরা। সমস্বরে ভয়ানক চিৎকার করতে করতে সাগরের ঢেউয়ের মতো ধেয়ে এলো আমাদের দিকে। একটা লোকের ধড় থেকে মাথা নামিয়ে দিলো লিও। পর মুহূর্তে দেখলাম, আমি আর ঘোড়ার পিঠে নেই। বুনো উল্লাসে একদল অসভ্য টানতে টানতে আমাকে নিয়ে চলেছে আগুনের দিকে। পাথর খুঁড়ে গভীর একটা গর্ত করা হয়েছে, তার ভেতর জ্বলছে আগুন। টেনে হিচড়ে আমাকে গর্তের কিনারে নিয়ে ফেললো ওরা। ঘাড় ফিরিয়ে চকিতের জন্যে দেখলাম সাত-আট জন জংলীর সাথে একা লড়ছে লিও। কিছুতেই এঁটে উঠতে পারছে না। তার মানে আর আশা নেই আমার।
টানা হ্যাচড়ায় কুকুরে কামড়ানো হাতটার যন্ত্রণা দ্বিগুণ হয়ে উঠেছে। তবু গর্তটার ভেতর চোখ পড়তেই ভুলে গেলাম সে যন্ত্রণার কথা। আগুনের শিখা আমার মাথা ছাড়িয়ে উঠেছে। ভেতরটা লাল, গন গন করছে। তীব্র আঁচ গায়ে এসে লাগছে। আমাকে ঠেলে ফেলে দেয়ার জন্যে তৈরি হলো ওরা। চোখ বুজলাম আমি। জীবনের সমস্ত মধুর স্মৃতি মুহূর্তে ভেসে গেল চোখের সামনে দিয়ে। তারপর হঠাৎ, শক্ত হয়ে চেপে বসা জান্তব হাতগুলো ঢিলে হয়ে গেল। না, আগুনে নয়, মাটির ওপর চিৎ হয়ে পড়ে গেছি আমি। তাকিয়ে আছি উপর দিকে।
যা দেখলাম, কল্পনাতীত! আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের সেই প্রেত-দর্শন পথপ্রদর্শক। তীব্র ক্রোধে কাঁপছে সে। এক হাত উঁচু করা বিশালদেহী পুরোহিতের দিকে। এখন আর একা নয়, সাদা আলখাল্লা পরা জনা বিশেক তলোয়ারধারী রয়েছে তার সঙ্গে। কালো চোখ সব কজনের, এশীয় চেহারা; গাল, মাথা পরিষ্কার করে কামানো।
একটু আগেই খ্যাপা ষাঁড়ের মতো গর্জাচ্ছিলো জংলীগুলো, এখন ছুটে পালাচ্ছে যে যেদিকে পারছে সেদিকে, যেন ভেড়ার পালে নেকড়ে পড়েছে। সাদা আলখাল্লাধারী পুরোহিতদের একজন, সম্ভবত দলনেতা, সামনে এগিয়ে এলো। জংলী পুরোহিতের দিকে তাকিয়ে ধমকাতে লাগলো সে। ভাষাটা কিছু কিছু বুঝতে পারলাম আমি।
কুকুর, শান্ত মাপা মাপা স্বরে সে বললো। অভিশপ্ত কুকুর, জানোয়ারের উপাসক, পাহাড়ের সর্বশক্তিময়ী মায়ের অতিথিদের কি করতে যাচ্ছিলি? এজন্যেই কি তোদের এতদিন বাচিয়ে রাখা হয়েছে? জবাব দে, কিছু বলার আছে তোর? তাড়াতাড়ি বল! তোর সময় ঘনিয়ে এসেছে!
ভীত একটা আর্তনাদ বেরোলো লাল, দাড়িওয়ালা বিশালদেহীর গলা চিরে। ছুটে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসলো-প্রধান পূজারীর সামনে নয়, আমাদের পথ-প্রদর্শক প্রেত-দর্শন মূর্তির সামনে। হাউমাউ করে আউড়ে চললো সে ক্ষমা ভিক্ষার আবেদন।
থাম! বলে উঠলো প্রধান পুরোহিত। উনি মায়ের প্রতিনিধি, বিচারের মালিক। আমি কান এবং কণ্ঠস্বর, যা বলার আমাকে বল! যাদেরকে দ্রভাবে সহৃদয়তার সাথে স্বাগত জানাতে বলা হয়েছিলো তাদের হত্যা করতে গিয়েছিলি কি না? উহুঁ, মিথ্যে বলে লাভ হবে না, আমি সব দেখেছি। তোকে ফাঁসানোর জন্যেই ফাঁদ পেতেছিলাম আমরা। অনেক দিন বলেছি, ওসব বর্বর রীতি ছাড়, শুনিসনি। এবার তার মূল্য দে।
তবু বেচারা ক্ষমা ভিক্ষা করে চললো।
দূত, প্রধান পুরোহিত বললো, আপনার মাধ্যমেই শক্তির প্রকাশ ঘটে। রায় দিন।
ধীরে ধীরে হাত তুললো আমাদের পথপ্রদর্শক। আগুনের দিকে ইশারা, করলো। মুহূর্তে ছাইয়ের মতো সাদা হয়ে গের লোকটার মুখ। আর্তনাদ করে পিছিয়ে গেল।
জংলীদের সবাই পালিয়ে যায়নি। দু-একজন রয়ে গিয়েছিলো। তাদের দিকে তাকিয়ে কাছে আসার ইঙ্গিত করলো পূজারী। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে এক পা দুপা করে এগিয়ে এল তারা।
দেখ, বললো সে, মা হেস-এর বিচার দেখ। মা-র অবাধ্য হলে, তোদর বেলায়ও এমন হবে। এখন তুলে আন তোদের সর্দারকে।
কয়েকজন এগিয়ে এসে নির্দেশ পালন করলো।
ফেলে দে ঐ গর্তে। অপরকে পোড়ানোর জন্যে যে আগুন জ্বেলেছিস তাতে নিজেই পুড়ে মর।
এবারও নিঃশব্দে নির্দেশ পালন করলো ওরা। মাংস, চামড়া পোড়ার উৎকট গন্ধ ছুটলো কয়েক সেকেণ্ড তারপর সব আবার আগের মতো।
শোন তোরা, পুরোহিত বললো, ওর পাওনা শাস্তি ও পেয়েছে। এই বিদেশীরা যে মেয়েটাকে বাঁচিয়েছে তাকে কেন ও খুন করতে চেয়েছিলো জানিস? তোরা ভাবছিস ডাইনী বলে। শুনে রাখ, তা নয়। মেয়েটিকে ও স্বামীর কাছ থেকে কেড়ে নিতে চেয়েছিলো। পারেনি, তাই প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে এ কাজ করতে যাচ্ছিলো। কিন্তু চোখ দেখেছে, কান শুনেছে, কণ্ঠস্বর কথা বলেছে, এবং দূত বিচার করেছেন।
পর্বত গর্ভের অগ্নিসিংহাসনে বসে এমনি চুলচেরা বিচার করেন হেসা।
.
১৩.
একে একে প্রায় পা টিপে টিপে চলে গেল আতঙ্কিত জংলীরা।
প্রভু, কালুন রাজসভার পারিষদরা যেমন বলে তেমন বিকৃত গ্রীকে বললো প্রধান পুরোহিত, আপনি আঘাত পেয়েছেন কিনা জিজ্ঞেস করবো না। কারণ, জানি পবিত্র নদীতে পা রাখার মুহূর্ত থেকে অদৃশ্য এক শক্তি রক্ষা করছে আপনাদের। তবু অপবিত্র হাত আপনাদের ওপর পড়েছে, মায়ের নির্দেশ, আপনারা চাইলে ওদের প্রত্যেককে আপনাদের সামনে হত্যা করা হবে। বলুন, তা-ই চান?
না, জবাব দিলো লিও। ওর বর্বর, অন্ধ। আমরা চাই না আমাদের জন্যে আরও রক্ত ঝরুক। আমরা চাই, বন্ধু-কি বলে ডাকবো আপনাকে?
অরোস।
বন্ধু অরোস, আপাতত আমরা চাই খাবার আর আশ্রয়। তারপর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পৌঁছুতে চাই আপনি যাকে যা বলছেন, যার খোঁজে আমরা এত দূরের পথ পাড়ি দিয়ে এসেছি তার কাছে।