এমন সময় পেছনে একটা খসখস আওয়াজ শুনে আমি ঘাড় ফিরিয়ে তাকালাম। ঘরটার আয়তন দ্বিগুণ হয়ে গেছে। আমার একটু পেছনেই একটা পর্দা ঝুলছিলো। ভেবেছিলাম, ওটা বুঝি দেয়ালে ঝুলছে। এখন বুঝলাম, না, ঐ পর্দা দিয়ে ঘরটাকে দুভাগ করা হয়েছিলো। পর্দার ওপাশের অংশে শামানের শোয়ার জায়গা। মেঝেতে, বিছানায় পড়ে আছে তার যাদুবিদ্যার যন্ত্রপাতি, রাশিচক্র ইত্যাদি। আর পর্দা ধরে দাঁড়িয়ে আছে মূর্তির মতো খানিয়া আতেন।
অপরাধের কথা বললো কে? শীতল গলায় প্রশ্ন করলো সে। তুমি, প্রভু লিও?
চেয়ার থেকে উঠে খানিয়ার মুখোমুখি হলো লিও।
হয়তো আপনি আহত হয়েছেন, খানিয়া, কিন্তু আমি খুশি, আপনি আমার কথা শুনে ফেলেছেন।
কেন, আহত হবো কেন? অন্তত একজন সৎ সত্যবাদী লোকের দেখা পেলাম জীবনে। না, আমি তোমার কথায় মোটেই দুঃখ পাইনি। কিন্তু, লিও ভিনসি, নিয়তির লিখন খণ্ডানো কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। যা একবার লেখা হয়ে গেছে তা, মোছা সম্ভব নয়।
নিঃসন্দেহে, খানিয়া; কিন্তু কি লেখা হয়ে গেছে?
ওকে বলো, শামান।
পর্দার ওপাশে চলে গেল সিমব্রি। একটা তুলোট কাগজের টুকরো নিয়ে এসে পড়তে লাগলো: স্বর্গ তার অনির্বাণ সংকেতের মাধ্যমে ঘোষণা করছে যে, পরবর্তী নতুন চাঁদের আগেই খান র্যাসেন মারা যাবে। দুর্গম পাহাড় পেরিয়ে যে আগন্তুক প্রভু এসেছে তার হাতে সে নিহত হবে।
স্বর্গ তাহলে মিথ্যা ঘোষণা করেছে, বললো লিও।
তা তোমার মনে হতে পারে, জবাব দিলো আতেন, কিন্তু যা পূর্ব নির্ধারিত তা ঘটবেই। আমার হাতে নয়, আমার কোনো ভৃত্যের হাতে নয়, তোমার হাতেই মরবে ও।
কিন্তু, আমার হাতে কেন? কেন হলির হাতে নয়? তবু, অমন কিছু যদি ঘটেই, খানের শোকাতুর স্ত্রী নিশ্চয়ই প্রতিশোধ নেবেন?
ঠাট্টা করছো, লিও ভিসি, আমার এই স্বামীকে আমি কি চোখে দেখি তা জানার পরও?
বুঝতে পারছি প্রকৃত সংকটের মুহূর্ত উপস্থিত। লিও-ও বুঝতে পেরেছে। ও বললো-আপনার উদ্দেশ্য কি পরিষ্কার করে বলুন, খানিয়া। আমাদের দুজনের জন্যেই তা মঙ্গলজনক হবে।
হ্যাঁ, বলবো, প্রভু। এই নিয়তি নির্ধারিত ব্যাপারের শুরু কোথায় আমি জানি না। যেখান থেকে জানতে শুরু করেছি সেখান থেকেই বলছি। শোনো, লিও ভিনসি, আমি যখন শিশু তখন থেকেই তুমি হানা দিয়ে চলেছে আমার মনে। প্রথম যখন তোমাকে নদীর পাড়ে দেখি, তোমার মুখ আমার অপরিচিত মনে হয়নি। বরং মনে হয়েছে, যেন কতদিনের চেনা। স্বপ্নের ভেতর তোমার সাথে আমার এই পরিচয়। আমি তখন খুব ছোট, নদীর তীরে ফুলের ভেতর শুয়ে ছিলাম একদিন, তুমি সেদিন প্রথম এলে আমার স্বপ্নে—বিশ্বাস না হয় আমার চাচাকে জিজ্ঞেস করে দেখ, সত্যি বলছি কিনা। তুমিও তখন খুব ছোট। তারপর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর তুমি এসেছো আমার ঘুমের ভেতর। অবশেষে আমি বুঝতে শিখেছি তুমি আমার। আমার হৃদয়ের যাদুই আমাকে এ জ্ঞান দিয়েছে।
তারপর অনেক বছর কেটে গেছে, তুমি আরও কাছাকাছি হয়েছে আমার; ধীরে, খুব ধীরে কিন্তু প্রতি মুহূর্তেই কাছে এসেছে। অবশেষে বহু প্রতীক্ষিত দিনটি এলো। পাহাড় পেরিয়ে, মরুভূমি তুষার পেরিয়ে সশরীরে তুমি এলে আমার সামনে (তিন চাঁদ আগে এক রাতে চাচা শামানের সঙ্গে বসে ছিলাম আমি এই ঘরে, যাদুবিদ্যার পাঠ নিচ্ছিলাম। সেই সময় হঠাৎ অলৌকিক এক দৃশ্য ভেসে, উঠলো আমার মনের পর্দায়।
তোমাকে দেখলাম-হা, স্বপ্নে নয়, জেগে জেগে। দেখলাম, তুমি আর তোমার সঙ্গী কোনোমতে ঝুলে আছে সেই গিরিখাতের মাঝামাঝি এক ভাঙা বরফের কানায়। দেরি না করে চাচাকে নিয়ে চলে গেলাম সেখানে। বুকের ভেতর দুরু দুরু করছিলো, হয়তো এরমধ্যে ঐ ভয়ানক জায়গা থেকে পড়ে মরে গেছে তোমরা।
তারপর, যখন আমরা অপেক্ষা করছি, হঠাৎ দেখতে পেলাম ছোট দুটো মূর্তি, অনেক উপরে, বিপজ্জনকভাবে নেমে আসছে বরফের থাম বেয়ে। বাকিটুকু তোমরা জানো। রুদ্ধশ্বাসে আমরা দেখলাম, তুমি পড়ে গিয়ে ঝুলতে লাগলে রশি বাঁধা অবস্থায়। হ্যাঁ, তারপর তোমার সাহসী সঙ্গীকে দেখলাম, তোমার পেছন পেছন ঝাঁপ দিলো।
কিন্তু, শেষ পর্যন্ত কে উদ্ধার করলো তোমাকে? চাচা লাঠি এগিয়ে দিয়েছিলো। কোনো লাভ হয়েছিলো তাজে আসলে সব নিয়তির বিধান, তুমি আমি চাইলেই কি খণ্ডাতে পারবো?
শেষ করলো আতেন। একটু ঝুঁকে বসলো টেবিলে। লিওর দিকে চোখ।
আপনি আমাকে বাঁচিয়েছেন, লিও বললো, সেজন্যে আবার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। কিন্তু যা বললেন তা যদি সত্যি হয় আরেকজনকে বিয়ে করলেন কেন?
এবার যেন কুঁকড়ে গেল খানিয়া।
ওহ! সেজন্যে আমাকে দোষ দিও না। দেশের স্বার্থে পাগলটাকে বিয়ে করতে হয়েছে। সবাই এমনভাবে ধরেছিলো। হ্যাঁ, তুমিও, চাচা সিমব্রি। কেন? জনগণের স্বার্থে র্যাসেন আর আমার রাজ্যের ভেতর যুদ্ধ বন্ধ করা দরকার। ওকে বিয়ে করলেই তা নাকি সবচেয়ে সহজে সম্ভব। হায়রে জনগণ! হায়রে আমার দেশ!
বুঝলাম আপনার দোষ নেই, বললো লিও। কিন্তু ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক ঐ লোকটাকে বিয়ে করে যে গেরো আপনি দিয়েছেন, ওর প্রাণ হরণ করে আমি কেন তা কাটতে যাবো? তাছাড়া স্বর্গের ঘোষণা আর অলৌকিক দর্শনের যে কথা আপনি বলছেন তা আমি এক বিন্দু বিশ্বাস করিনি। আপনি আমাদের উদ্ধার করতে গিয়েছিলেন, কারণ মহাশক্তিমতি হেসা, অগ্নিপর্বতের আত্মা আপনাকে সেরকমই নির্দেশ দিয়েছিলেন।