এই বলেই সে আবার ঝড়ের বেগে বেরিয়ে এল, বোধ হয় ফারাওনন্দিনীকে অভ্যর্থনা করে আনবার জন্যই। যুবরাজ আর এসে আসন গ্রহণ করলেন না। কক্ষের মাঝখানেই দাঁড়িয়ে রইলেন দরোজার দিকে মুখ করে। আমি যে টেবিলে বসে খুবই বিপন্ন বোধ করতে থাকব এই পরিস্থিতির মাঝখানে পড়ে, তা কি আর তিনি বুঝতে পারেননি? আমার দিকে না তাকিয়েও, পিছন পানে হাত নেড়ে তিনি আশ্বস্ত হতে বললেন আমায়, আশ্বাস আমি পেলাম বই কি! ঘর ছেড়ে পালাবার একটা কল্পনা মাথায় এসেছিল, সেটাকে মগজ থেকে বার করে দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। এবং এমন ভাবে দাঁড়ালাম যাতে আমার নাতিক্ষুদ্র কলেবরখানা যুবরাজের আড়ালেই থাকে যথাসম্ভব।
এলেন উসার্টি, মহিমান্বিতা যুবরানি মিশরভূমির। রুদ্ধ কক্ষে যেন একটা বাতায়ন খুলে গেল হঠাৎ, আর সেই বাতায়ন পথে যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ল এসে মধ্যাহ্ন সূর্যের আলোর প্রপাত। মহিমময়ী মূর্তি। যে কোনোদিন দেখেনি, পরিচয় পায়নি, সেও প্রথম দৃষ্টিতেই উপলব্ধি করবে যে সমুখে যার আবির্ভাব ঘটল, বহুযুগের রাজমহিমার উত্তরাধিকারিণী তিনি, মহাবাহু মহান রামেসিসের রক্ত খরবেগে বইছে তার ধমনীতে।
“ভাল আছ তো?” সম্ভাষণ ঊটির।
“ভাল আছ তো?” সম্ভাষণ জানালেন শেঠি।
“ও-লোকটা কে?”প্রাকুটি ফুটে উঠল রাজনন্দিনীর ললাটে। চেষ্টা করেও নিজেকে আমি লুকোতে পারিনি যুবরাজের আড়ালে।
“আমার এক নবলব্ধ বন্ধু। বিখ্যাত গল্পলেখক। মেক্ষিসের অ্যানা। সুখবর শোনো, উনি এখন থেকে আমায় সঙ্গদান করতে রাজি হয়েছেন। থাকবেন এখানেই।”
“খাবেনও তোমার টেবিলেই?”–এইমাত্র যে একসাথে বসে খেয়েছি, টেবিলের দিকে তাকিয়েই রাজনন্দিনী তা ধরে ফেলেছেন। বিরক্ত হয়েছেন অতিমাত্রায়। কথা যখন কইলেন, সে বিরক্তি যেন সূঁচ দিয়ে বিঁধিয়ে বিঁধিয়ে আমার মগজে ঢুকিয়ে দিলেন–“শেঠি! শেঠি! নিজের পদমর্যাদা সম্পর্কে সম্যক ধারণা কবে আর জন্মাবে তোমার? একটা অভিজাতবংশীয় লোক হলেও বা আমরা তাকে সহ্য করে নিতে পারতাম তোমার সহচর হিসাবে। কিন্তু এ কী বল তো? লেখক? যারা মাটিতে বসে হাঁটুর উপরে প্যাপিরাস নিয়ে খাগড়ার কলম দিয়ে সাঁই সাঁই লিখে যায় অন্য লোকের মুখের কথা? অ্যামন-রা বা মাট বা টা, যে-দেবতার কথা বলবে, তারই শপথ নিয়ে আমি বলতে পারি।”
‘কিছু বলতে হবে না ভগ্নি, কিছু বলতে হবে না”–উসার্টিকে থামিয়ে দিলেন–“আমরা সবাই জানি যে রাজমর্যাদার বোঝা বইবার মতো শক্ত পিঠ তোমার যেমন আছে, তেমন আর ফারাও বংশধরের অন্য কারও নেই। কিন্তু কথাটা কী? বিনা কারণে তুমি যে রাত দুপুরে এই অপদার্থ ভাইটার ডেরায় পদার্পণ করনি, এটা অনুমান করে নিয়েই আমি সবিনয়ে জানতে চাইছি কথাটা কি?”
“কথাটা একটু গুরুতরই”-রাজনন্দিনীর কণ্ঠস্বর দস্তুরমতো কটু–“তুমি নাকি আজই সন্ধ্যায় অকারণে এক সৈনিকের শিরচ্ছেদের আদেশ দিয়েছিলে?”
শেঠি হঠাৎ কৌতুকে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন, ফিরে তাকালেন আমার দিকে, পাশের দিকে এভাবে সরে গেলেন যে উসার্টির আর আমার মধ্যে অন্তরাল . আর কিছুমাত্র রইল না। আগে উসার্টি, শেঠি আর আমি ছিলাম একই সরলরেখায়, এখন তিনজনে দাঁড়ালাম ত্রিভুজের তিনটি কোণবিন্দুতে।
হ্যাঁ, উসার্টিকে আর আমাকে চোখাচোখি দৃষ্টি বিনিময়ের সুযোগ করে দিয়ে যুবরাজ হাসতে হাসতে বললেন–“বন্ধু অ্যানা, একটা কথা আছে না যে মানুষ যত বাঁচবে, তত শিখবে। আজ একটা নতুন শিক্ষা পেলাম। এতকাল আমার জানা ছিল যে ফারাওয়ের দোরগোড়ায় ঘটছে যে-সব ঘটনা, তাও ফারাওয়ের কানে পৌঁছোতে লাগে ছয় মাস অন্তত। আজ কিন্তু দেখছি, অর্ধপ্রহর পেরুতে পেরুতে পুত্রের কুকীর্তির কথা জেনে ফেলেছেন সম্রাট। এর চেয়ে আশ্চর্য আর কী হতে পারে?”
“মোটেই এটা আশ্চর্য নয়, কারণ সম্রাটের কানের গোড়ায় সারাক্ষণই মোতায়েন রয়েছেন তোমার আমার জ্যাঠতুতো ভাই, রাজপুত্র আমেনমেসিস। তার চর আছে সারা মিশরে। এমন ঘটনা মিশরে ঘটে না, যার খবর সঙ্গে সঙ্গে তিনি পান না। সব খবরই পান, আর তোমার কুকীর্তিঘটিত কোনো খবর হলে তখনই তা পেশ করেন ফারাওয়ের সমুখে! ফারাওয়ের স্নেহ থেকে তোমায় বঞ্চিত করবার জন্য আমেনমেসিস যে নিজের ডান হাতখানা কেটে ফেলতে পারে, এটা তুমি সর্বদা মনে রেখো।”
শেঠির যেমন স্বভাব, একটা কিছু হালকা জবাবই দিতে যাচ্ছিলেন উসার্টিকে, কিন্তু উসার্টিই থামিয়ে দিলেন তাকে–“এ-সব কথা তৃতীয় ব্যক্তির সমুখে আলোচনা করা ঠিক নয়। তোমার যদি হ্রস্বদীর্ঘ জ্ঞান থাকত, তোমার ঐ লেখক বন্ধুকে অন্যত্র পাঠাতে, আমি ঘরে ঢুকবার আগেই। কিন্তু তা নেই যখন, আমি একটা মাত্র কথা, যে-কথা শুরু করেছিলাম, সেইটি বলেই এখনকার মতো প্রস্থান করব। অর্থাৎ, বাজার চত্বরে কাপ্তেন খুয়াকার শিরচ্ছেদের ব্যাপারটা নিয়ে ফারাওয়ের দরবারে যা একটু চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে, তারই কথা।”
“চাঞ্চল্য!’–হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন শেঠি–“চাঞ্চল্য কেন হবে? ট্যানিসের প্রশাসক হিসাবে ট্যানিসৰাসীদের জীবনমরণের মালিক আমি। আমি বিচার করে যা করব, তা নিয়ে আলোচনার অধিকার কারও নাই।”
“ফারাওয়ের আছে”–দৃঢ়স্বরে বললেন উসার্টি–“আর ফারাওই ব্যাপারটা শুনতে চান তোমার মুখ থেকে। দরবারে আমিও ছিলাম সন্ধ্যাবেলায়। উঠে আসবার সময় ফারাও আমায় আদেশ করলেন তোমাকে দুটি কথা জানার জন্য। একটা হল এই যে, কাল সকালে তুমি দরবারে হাজির হবে এবং খুয়াকাঘটিত সব বৃত্তান্ত জানাবে তাকে। তাঁর দ্বিতীয় কথাটা আমি আর তুলছি না এখন। সেটা তৃতীয় ব্যক্তির সামনে তোল চলে না বলেই তুলছি না। সেটার সম্বন্ধে যা বলবার ফারাও নিজেই বলবেন তোমায়।”