ইনি হলেন রাজনন্দিনী উসার্টি। ফারাওয়ের মহামান্যা দুহিতা মিশরের যুবরানি, ভবিষ্যতে সিংহাসনের অর্ধেকের অধিকারিণী।
আমরা প্রাসাদে ফেরার পরেই যুবরাজের নিজস্ব বৈদ্য এসে আমার জানুর সামান্য ক্ষতটা পরীক্ষা করলেন, মলম লাগিয়ে ব্যান্ডেজও করে দিলেন একটা। দেহের অস্বস্তি যখন খানিকটা হালকা হয়ে এল এইভাবে, তখন যুবরাজে আনিয়ে দিলেন নতুন পরিচ্ছদ আমার জন্য, তারপর আমায়, এই দীনহীন লেখককে পাশে নিয়ে বসলেন খেতে।
আশ্চর্য হয়ে গেলাম। মিশর সিংহাসনের উত্তরাধিকারীর টেবিলে এই সামান্য আহার্য? দুটি মাত্র পদ, একটা নিরামিষ, একটা আমিষ। কোনোটাতেই বিশেষ মশলাপাতির প্রাচুর্য নেই। তাই দিয়েই পরম তৃপ্তি সহকারে ভোজন শেষ করলেন যুবরাজ। বরাবর যে তিনি ঐ রকম সাদাসিধে খাদ্যেই অভ্যস্ত, তাতে আর সন্দেহ রইল না আমার। একটা কথা থেকে থেকেই মনে পড়ছিল আমার, রাজর্ষি ইনি। এই যুবরাজ শেঠি। রাজর্ষি। ভোগসুখে নিস্পৃহ। এই নবীন যৌবনেই।
খেতে খেতে একটি প্রস্তাব করলেন যুবরাজ। তিনি আমাকে নিজের কাছেই রেখে দিতে চান, তাঁর নিজস্ব লেখক ও একান্ত সচিব করে। তাছাড়া, প্রাসাদে যে গ্রন্থসংগ্রহটি রয়েছে তার, তার তত্ত্বাবধায়কও বটে। বিনিময়ে যে-বেতনের কথা উল্লেখ করলেন তিনি, তার পরিমাণ আমার যোগ্যতার বিচারে খুবই বেশি বলে মনে হল আমার। কিন্তু আদায় করতে পারবে বলে আশা করো না। বেতন নির্ধারণের মালিক আমি বটে, কিন্তু বেতন দেওয়ার মালিক উজির নেহেসি। সে যে কী বস্তু, তুমি কল্পনাই করতে পারবে না। রাজকোষের এক একটা মুদ্রা যেন তার দেহের এক এক বিন্দু রক্ত। যা হোক, থাকবে তো তুমি আমার সঙ্গেই, খেতে না পেয়ে মরে যাবে না, এটুকু আশ্বাস আমি দিতে পারি। বেতন যদি পাও, যতটা পাবে ততটাই উপরি পাওনা বলে ধরে নিও।”
খেতে খেতে এক এক চুমুক পানীয়ও অবশ্য খাচ্ছিলাম আমরা। যে যার নিজস্ব পেয়ালা থেকে। এইবার কিন্তু তাক থেকে একটি স্ফটিকের পেয়ালা নিয়ে এলেন যুবরাজ, নতুন ধরনে তৈরি এক অতি সুন্দর পেয়ালা। সেই পেয়ালাতে কানায় কানায় দ্রাক্ষারস ঢেলে তিনি নিজে প্রথমে তা থেকে খেলেন একটু, তারপর পেয়ালা এগিয়ে দিলেন আমার দিকে “খেয়ে ফেল। তোমার আমায় আজ থেকে স্থাপিত হোক অচ্ছেদ্য বন্ধুত্ব। দুই দেহে এক প্রাণ হবে আমাদের। সূর্য-ক্ষেত্রজ যমজ ভাই আমার আরও অনেক আছে মিশরে, কিন্তু আত্মার আত্মীয় হবে তুমি একাই।”
“কী পুণ্যবলে আমার এ মহৎ সম্মান?’–আবেগে অভিভূত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
“পুণ্যবলে নয়, হৃদয়বত্তার গুণে। দুবৃত্ত খুয়াকাকে আক্রমণ করে তুমি নিজের জীবন বিপন্ন করেছিলে। অথচ, তার সঙ্গে তোমার ব্যক্তিগত কলহ কিছুই ছিল না। সেই যে দুটো অপরাধ খুয়াকার, নাথানের হত্যা এবং আমার গালে চপেটাঘাত, এদের সঙ্গে তুমি নিজেকে জড়িয়ে ফেলবে, এ-প্রত্যাশা কেউ করেনি। তবু তুমি ফেলেছিলে জড়িয়ে। ঐখানেই প্রমাণ যে হৃদয় তোমার মহৎ।”
একটু থেমে তারপর একটু হাসলেন শেঠি –“তোমাকে চাকরি দিয়ে এই যে নিজের কাছে আমি রাখতে চাইছি, এটার পিছনে আমার কোনো উদারতা নেই বন্ধু, বরং আছে পরিপূর্ণ স্বার্থবুদ্ধি। দুনিয়ায় মোটামুটি সৎ লোকই খুঁজে পাওয়া যায় না যেখানে, সেখানে যদি হঠাৎ আমি একটা মহৎ লোকের দেখা পেয়ে যাই দৈবানুগ্রহে, তাকে নিজের লোক করে নেবার একটা চেষ্টা তো আমি নিশ্চয়ই করব। নিজের উপকারের জন্যই করব?”
কথায়বার্তায় স্ফটিক পেয়ালার পানীয়টা শেষ হয়ে এসেছিল। এইবার সেটাকে সমুখে রেখে যুবরাজ চিন্তিতভাবে বললেন–“এটিকে নিয়ে এখন কী করা যায়? আমাদের বন্ধুত্বের সঙ্গে এ জিনিসটার যখন ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয়ে গেল একটা, তখন এটা দেখতে হবে যে ভবিষ্যতে এ গিয়ে যেন আজেবাজে লোকের হাতে না পড়ে।”
“ভবিষ্যতে কী হবে, তা আজই কেমন করে জানা যায় যুবরাজ?” বললাম আমি।
“তা তো যায়ই না। আর যায় না বলেই ভবিষ্যৎ বলে আমি কিছুই রাখব না এ-পেয়ালাটার।”–এই বলে, তাক থেকে একটা ছোট্ট পাথরের হাতুড়ি নিয়ে পেয়ালার ঠিক মাথায় তা দিয়ে সবলে আঘাত করলেন যুবরাজ।
আর আশ্চর্য! আঘাত পেয়ে পেয়ালাটা গুঁড়ো গুড়ো হয়ে গেল না, যদিও তাই যাওয়াই ছিল সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। গুঁড়ো হয়ে গেল না, হয়ে গেল দুই ভাগ। এ যে কেমন করে হল, কিছুই বুঝতে পারলাম না আমরা, যুবরাজ বা আমি। আস্ত থাকতে আর গঠন-কৌশলের ভিতরে কোনো বৈশিষ্ট্যই লক্ষ্য করিনি আমরা। অথচ বৈশিষ্ট্য তো ছিলই! অসাধারণ বৈশিষ্ট্যই ছিল কিছু।
উপর থেকে নীচ পর্যন্ত পেয়ালাটার মাঝামাঝি যেন করাত দিয়ে চিরে দুই ভাগ করে ফেলেছে কেউ। দুটো নিখুঁত অর্ধেক, কোনো দিকে এক চুল পরিমাণ চিড়ও খায়নি। যুবরাজ অনেকক্ষণ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নেড়েচেড়ে দেখলেন দুটো অর্ধাংশ, তারপর বললেন–“ভালই হল। একটা অর্ধেক তুমি নাও, আর একটা আমি নিই। আমরণ যত্ন করে রাখব আমরা, নিজের নিজের অংশ।”
একটা সুদৃশ্য পেটিকা ছিল গৃহকোণে, যুবরাজ গিয়ে নিজের অংশটি তারই ভিতর রেখে এলেন। আমার অংশ আমি আপাতত জামার ভিতরেই রাখলাম, পরে তুলে রাখব কোনো নিরাপদ স্থানে।
যুবরাজ ফিরে এসে টেবিলে বসবার সময় পাননি তখনো, আমিও জামার বোম সবগুলো তখনো এঁটে উঠতে পারিনি, এমন সময় দাড়িওয়ালা পাম্বাসা প্রায় ছুটতে ছুটতে কক্ষে এসে উঠল–“মহিমান্বিত ফারাওনন্দন! মহিমান্বিতা ফারাওনন্দিনী আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসছেন। এই এসে পড়লেন বলে।”